কিশোর বয়সে এদের কাহিনী ওয়েস্টার্ন বইয়ে পড়েছি। মুভিতে দেখেছি এদের উপর অত্যাচার, অনাচারের ছবি। স্বপ্নেও ভাবিনি একদিন সুযোগ হবে শহর হতে বেশকিছুটা দূরে শান্ত, স্থবির লোকালয়ে ওদের সাথে একই টেবিলে বসে সময় কাটাতে হবে। আগেই ঠিক করা ছিল সকাল ১০টায় আমি হাজির হব। নতুন একটা জনবসতির কাজ শুরু হবে। ফোন ও ইন্টারনেট কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ওদের হাউজিং অথরিটির অফিসে। হাইওয়ে ধরে ঘণ্টায় ১৩২ কিলোমিটার বেগে ড্রাইভ করলে চল্লিশ মিনিটের পথ। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। আর তার কোল ঘেঁষে জন-মানবহীন বিরানভূমি। আমাদের শহরটাই এরকম। এর উত্তর-দক্ষিণ, পূব-পশ্চিম যেদিক হতেই বের হইনা কেন প্রথমেই দেখা মেলবে পুয়েবলো গুলোর সাথে। পুয়েবলো হচ্ছে আদিবাসী আমেরিকানদের আবাসভূমির নাম। শব্দটা স্প্যানিশ। যদিও এর গোঁড়া এসেছে ল্যাটিন শব্দ পপুলাস অর্থাৎ পিপল হতে।
এর আগেও কাজ উপলক্ষে বেশকটা পুয়েবলো যেতে হয়েছে। তবে তা ছিল নির্দিষ্ট কোন বাসিন্দা অথবা বাড়িঘরে সীমাবদ্ধ। এবারের আয়োজন পুয়েবলোর হাই-অথোরিটি। একে একে সান্দিয়া, সান্তা আনা, সান ফেলিপে পুয়েবলো পিছু ফেলে গন্তব্য-স্থল সান্ত ডোমিনঙ্গো পুয়েবলোতে পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে গেল। অফিসের গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকতে দাঁত ফোকলা এক বৃদ্ধা গোটা মুখে হাসি ছড়িয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো। আমিও ঘাড় সহ মাথাটা বেঁকিয়ে প্রতি উত্তর দিলাম। ভেতরে ঢুকে একটু হতাশ হলাম। অফিসের কোন শ্রী নেই। চারদিকের সবকিছু অগোছালো। চেয়ারে যারা বসে আছে তাদের চেহারাও রুক্ষ। অনেকটা মঙ্গোলিয়ানদের মত নাক-মুখ থ্যাবড়ানো। দু'একজনের মাথার চুল মহিলাদের মত ঝুটি বাধা। নিজের পরিচয় দিয়ে বসে পরলাম খালি একটা চেয়ারে।
কর্পোরেট আমেরিকার এই ১২ বছরের চাকরি জীবনে অনেক অফিসেই আমাকে হাজিরা দিতে হয়েছে। এসব তালিকায় যেমন আছে বড় বড় ইউটিলিটি কোম্পানির নাম, তেমনি আছে অঙ্গরাজ্যের গভর্নর সহ শহরের মেয়রের নাম। পুয়েবলোর সবোর্চ্চ অথরিটির সাথে এটাই প্রথম। আমি জানতাম এখানে আমার অপ্রোচ হতে হবে ভিন্ন। ঘাড়ত্যাড়া কথা বললে চাকরি নিয়ে টান দিবে। দুই ঘণ্টার মিটিং ছিল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মিটিং। বিশেষকরে ফেডারেল গভর্মেণ্ট অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিনিধির সাথে। ওদের অভিযোগ বারাক ওবামার বিদায়ের পর নতুন প্রশাসন তাদের উপর হতে মুখ সরিয়ে নিয়েছে। ওয়াদা-কৃত কোন অর্থই ছাড় করছেনা। বিদ্যুৎ, পানি, সড়ক ও জনপথ সহ কোন অথোরিটিকেই রেহাই দেয়া হলনা। আমার টার্ম আসতে একটা কিলকি হাসি দিয়ে মনে করিয়ে দিলাম আমি প্রাইভেট কোম্পানির প্রতিনিধি। আমাদের কোন লিখিত দায়বদ্ধতা নেই। নতুন এলাকায় তোমরা আমদের ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক চাইলে তা নিয়মের পথ ধরেই আসতে হবে। বাকি লোকালয়ের জন্যে যে আইন পুয়েবলোর জন্যেও একই আইন। আমি এসেছি তোমাদের সেবা দিতে, ঝগড়া-বিবাদ করতে নয়। লম্বা তর্ক-বিতর্কের পর আমরা নির্দিষ্ট কিছু বোঝাপড়ায় আসলাম। আমার তাড়া ছিল, ছিল আগবাড়ায়ে বিদায় জানাতে বাধ্য হলাম। একজনের দিকে হাত বাড়াতে নিজকে পুয়েবলোর গভর্নর যো আগুলেয়র হিসাবে পরিচয় দিল। এবার আমার স্তম্ভিত হওয়ার পালা। আমার ঠিক পাশটায় যিনি বসা ছিলেন তিনিই হচ্ছেন পুয়েবলো প্রধান, যার সাথে খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখা করতে প্রয়োজন হয় পূর্ব অনুমতির। চেহারা না জানা থাকলে মনে হবে হোম-লেস রেড-ইন্ডিয়ানদের কেউ। মিটিং শেষ করে ফিরতি পথ ধরার আগে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিলাম পুয়েবলোর দিকে। হাইওয়ে হচ্ছে এ দেশের ফেডারেল সরকারের সম্পত্তি। তার দুদিক কাঁটাতারের বেড়া। এ বেড়ার বাইরে গেলেই শুরু হবে পুয়েবলোর সীমানা। এবং সে সীমানায় অন্য এক জগত, যেখানে শক্তিশালী মার্কিন সরকারেরও তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজস্ব প্রশাসন, পুলিশ আর বিচার ব্যবস্থা নিয়ে ওরা আমেরিকার ভেতরে থেকেই টিকিয়ে রাখছে নিজস্ব সত্ত্বা।
পুয়েবলোতে ছবি তোলায়ও আছে নিষেধাজ্ঞা।