শ্বশুরবাড়ির দেশে হওয়ায় পেরুর প্রতি আগ্রহটা বরাবরই একটু বেশি। নিয়মিতই যাওয়া হয় ওখানে। -প্রকৃতির পাশাপাশি দেশটার রাজনৈতিক প্রবাহ নিয়েও আগ্রহের শেষ নাই। বিশেষকরে ঘাত-সংঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাথে তৃতীয় বিশ্বের অন্য একটা দেশের তুলনা করার সুযোগ পাওয়া যায় বলে। কাজে ছিলাম বলে সময় মত জানা হয়নি। খবরটা ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দিল আমার গিন্নী। দেশটার দুই টার্মের প্রেসিডেন্ট এল্যান গার্সিয়া আত্মহত্যা করেছেন। প্রথম খবর ছিল ইন ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন, শেষমেশ খবর এলো, বেঁচে নেই। পেড্রো পাবলো কুজিনস্কি নির্বাচিত হওয়ার আগে ২০১১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের ফুল টার্ম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জনাব গার্সিয়া। এর আগে ১৯৮৫ সাল হতে ১৯৯০ পর্যন্ত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রথম টার্ম পূর্ণ করেছিলেন।
ক্ষমতা বড় লোভনীয় জিনিষ। একবার এর স্বাদ চেখে দেখলে অনেকটা চীনা জোকের মত চেপে বসে চাওয়া-পাওয়ায় সমীকরণে। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ। পেরুর অবস্থা অবশ্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভাল। পাঁচ বছর পর পর এখানে নির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন নেই। আপাতদৃষ্টিতে যোগ্য প্রার্থীদেরই নির্বাচিত করে পেরুভিয়ানরা। সমস্যা দেখা দেয় নির্বাচিত হওয়ার পর। দুর্নীতির শিকর এদেশেও অনেক পোক্ত এবং চলে যায় অনেক গভীরে। এল্যান গার্সিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল ব্রাজিলিয়ান নির্মাণ কোম্পানি ওদেব্রেখট হতে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ নেয়ার। এল্যান গার্সিয়া বরাবরই অস্বীকার করে আসছিলেন এ অভিযোগ। কিন্তু শেষপর্যন্ত ধোপে টেকেনি তার ডিফেন্স।
প্রমাণ হাতে পাওয়ার সাথে সাথে আজ সকালে পুলিশ হাজির হয় গার্সিয়ার রাজধানী লিমাস্থ মিরাফ্লোরেজ এলাকার বাসায়। ঘটনা আঁচ করতে পেরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেননি দেশটার সাবেক প্রেসিডেন্ট। ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি ছুড়ে নিজকে নিয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত বছর ২৩শে মার্চ দেশটার আরেক প্রেসিডেন্ট পেড্রো পাবলো কুজিনস্কি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন একই অভিযোগ মাথায় নিয়ে। বিচার শুরুর আগে এখন পর্যন্ত তিনি জেলের বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, ঘুষ এবং একই ব্রাজিলিয়ান কোম্পানির সাথে যোগাযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। তারও আগে নতুন পেরুর রূপকার আলবার্তো ফুজিমোরি দুর্নীতি, ঘুষ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জেলে যান ২০০৭ সালে। এবং সেখানেই মৃত্যুর প্রহর গুনছেন মরনব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে।
সময়টা ছিল পেরুর জন্য ঘোর আমনিশার সময়। দেশের যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, খাদ্য, আবাসন ব্যবস্থা সহ অর্থনীতির সবক্ষেত্রে ভঙ্গুর অবস্থা। এমনি এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থায় জাপানী ইমিগ্রেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি শক্ত হাতে হাল ধরেন পেরুর। নির্মমভাবে দমন শুরু করেন বামপন্থী গেরিলা দল সাইনিংপাথ ও তার নেতা Manuel Rubén Abimael Guzmán Reynoso কে। পেরু ঘুরে দাঁড়ায় এবং ফুজিমোরির নেতৃত্বে শুরু হয় নতুন যাত্রা।
কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়...পেরুতে বাঘের ভয় না থাকলেও রাত শুরু হতে সময় লাগেনি। এবং সে রাতের সূচনা ফুজিমোরিরই হাতেধরে। বেচারা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন সময় ঘনিয়ে আসছে, তাই ক্ষমতার শেষদিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন পিতৃভূমি জাপানে। ওখান হতে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন। পেরুভিয়ান গ্রহন করেনি তার পদত্যাগ। বরং কংগ্রেসের জরুরি অধিবেশনে ইম্পিচ করা হ্য পলাতক প্রেসিডেন্টকে। পেরুর প্রতিবেশী দেশ চিলিতে বেড়াতে এসে ধরা পরেন!। চিলিয়ান সরকার গ্রেফতার করে তাকে পাঠিয়ে দেয় পেরুতে। বিচার শেষে জেলই হয় তার শেষ ঠিকানা। যদিও যাচাই করে দেখা গেছে দেশের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ এখনো ফুজিমোরির সমর্থক, যার একজন স্বয়ং আমার গিন্নী।
পেরুর রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের সাথে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতির একটা সরলরেখা টানা গেলে কিছু জিনিষ পরিস্কার হয়ে যায়:
১) দুর্নীতির প্রভাব দু'দেশেই প্রকট। তবে পেরুতে তা যদি হয় ক্ষমতার উঁচু পর্যায়ে, বাংলাদেশে এর ব্যপ্তি মা'র জরায়ু হতে শুরু করে সাড়ে তিন হাত মাটির নীচ পর্যন্ত
২) বাংলাদেশের নির্বাচন ভুয়া, ধাপ্পাবাজি, জনগণের সাথে মধ্যরাতের প্রতারণা। পেরুর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।
৩) বাংলাদেশে জবাবদিহিতা নির্বাসনে। পেরুতে এ ধরণের কোন সমস্যা নেই।
৪) বিচার ব্যবস্থা। দু'দেশের মূল পার্থক্যটা এখানেই। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সরকারের দুর্নীতি নেটওয়ার্কের সক্রিয় সদস্য। পেরুতে তা স্বাধীন এবং সরকারী প্রভাবমুক্ত।
Moral of story is, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এবং তা বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশেই।