রাজা হরি সিং'এর নাম কি এর আগে কখনো শুনেছেন? না থাকলে ক্ষতি নেই। লাখো নামের ভীড়ে এমন একটা নাম জানা অথবা মনেরাখা তেমন জরুরি নয়। তবে আজকের কাশ্মীর নিয়ে আপনার ক্ষোভ দুঃখ থাকলে এই মানুষটার সাথে পরিচিত হওয়া আপনার জন্যে জরুরি। আসুন ফিরে যাই আপনার আমার জন্মের অনেক আগে, সেই ১৯৪৭ সালে। এই উপমহাদেশে ২০০ বছর দুধকলা খেয়ে বৃটিশরা যখন বুঝতে পারল দুধ ঘোলা হতে শুরু করেছে, কলায়ও পোকার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তখন তারা সিদ্বান্ত নিল, যথেষ্ট হয়েছে, আর না, এবার ঘরে ফেরার পালা। কিন্তু বললেই তো হুটকরে চলে যাওয়া যায়না। হাজার হলেও দুইশ বছরের ময়লা!
মোহম্মদ আলী জিন্নাহ আর জওহর লাল নেহেরু ততদিনে দুইমেরুর দুই নেতা। এক কথায় পালের গোদা, যাদের নেত্রীত্বে দুধ ঘোলা হচ্ছে।
সবার সমর্থন নিয়েই বৃটিশরা সিদ্বান্ত দিল, দুই ভাগে বিভক্ত হবে এ উপমহাদেশ। এবং নিজেরদের পছন্দ মতই রাজ্য গুলো যোগ দেবে প্রস্তাবিত ভারত ও পাকিস্তানে। যদিও নেহেরুর দল কোন মতেই চাইছিল না তাদের অখন্ড ভারত খন্ড-বিখন্ড হোক।
ধর্মীয় প্লাটফর্মের ভিত্তিতেই বিভক্ত হয় পাক-ভারত উপমহাদেশ। হিন্দুদের জন্যে হিন্দুস্থান আর মুসলমানদের জন্যে পাকিস্তান।
সমস্যা দেখা দেয় কাশ্মীর নিয়ে। সে রাজ্যে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের রাজা তখন একজন হিন্দু। এবং তিনিই আমাদের হরি সিং। ভারতের চাপ ছিল তাদের সাথে যোগ দেয়ার। কিন্তু মিঃ সিং সময় চাইলেন। কারণ তিনি জানতেন রাজ্যের মুসলমান জনগন তা সহজে মেনে নেবেনা। অন্যদিকে পাকিস্তান ছিল আরও মরিয়া। কারণ দেশটার একটা বিরাট অংশের পানি আসে প্রতিবেশী কাশ্মীর হতে। নতুন দেশের কৃষিকাজের অনেকটাই নির্ভর করবে ঐ অঞ্চলের পানির উপর। তারাও চাপ দিল রাজা হরি কে। রাজা তাতে কান দিলেন না। পাকিস্তানের তর সইছিলনা, তাই বিনা ঘোষণার জন্মের প্রথম প্রহরেই ঝাপিয়ে পরে কাশ্মীরের উপর। দখল করে নেয় বিরাট একটা অংশ। এই অংশটাই আজকে তাদের জন্যে আজাদ কাশ্মীর। রাজা হরি সিং চোখে অন্ধকার দেখেন। দ্রুত যোগযোগ করেন স্বধর্মী ভারতীয়দের সাথে। ভারত বাহু মেলে অপেক্ষায় ছিল এই মহেন্দ্রক্ষণের। আরও অনেক রাজ্যের মত কাশ্মীরকেও প্রস্তাব দেন এই ইউনিয়নে যোগ দিতে। রাজা রাজী হলেন, কিন্তু কিছু শর্তে। এই যেমন, কাশ্মীর এখনই ভারতের অংশ হবেনা। রাজ্যের জনগণকে সিদ্বান্ত নেয়ার জন্যে সময় দিতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে তারা সিদ্বান্ত নিবে ভারত না পাকিস্তানের দিকে ঝুকবে। নাকি স্বাধীন তৃতীয় একটা রাস্ট্রের দাবি জানাবে।
পাকিস্তানী আগ্রাসনের হাত হতে বাঁচার জন্যে রাজা হরি বিশেষ মর্যাদায় কাশ্মীরের বাকি অংশ নিয়ে ভারতের সাথে যোগদেন। কথা ছিল, ভারত পরিবর্তী সিদ্বান্ত না আসা পর্যন্ত কোনদিনই কাশ্মীরকে তাদের অংশ বলে দাবী করতে পারবেনা। বিদেশ ও সামরিক বিষয়ক দপ্তর গুলো বাদে বাকি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে কাশ্মীরি জনগণ। এমনকি তাদের নিজস্ব একটা পতাকা পর্যন্ত থাকবে।
দুদিন আগ পর্যন্ত এই বিশেষ মর্যাদা নিয়েই বেঁচে ছিল কাশ্মীরের জনগণ। কিন্তু গো-মূত্রখোর, নিরেট ধর্মীয় উন্মাদ নরেন্দ্র মোদি তার 'জয় শ্রীরাম' উন্মাদনায় আসক্ত ভোটারদের নিজের ক্যাম্পে ধরে রাখার মিশন হিসাবে কেড়ে নিয়েছে সেই বিশেষ মর্যাদা। উস্কে দিয়েছে গৃহযুদ্ধের দামামা। জন্ম দিয়েছে নতুন এক ফিলিস্তিনের।
ফিলিস্তিন সমস্যার মত কাশ্মীর সমস্যায়ও স্বধর্মীয় মুসলমানদের ফেলে ভারতের সাথে যোগ দিয়েছে সৌদি ও আমিরাতি রাজা-বাদশার দল। অনেকের জন্যে ব্যপারটা খটকার হলেও, যারা এই সৌদি ও আমিরাতী রাজপরিবারের ইতিহাসের সাথে পরিচিত তাদের জন্যে মোটেও খটকার ব্যপার না। গোটা ব্যপারটাই লেনাদেনার। বেনিয়া ভারতীয়দের চরিত্র ও লুচ্চা রাজপরিবারের চরিত্রে একবিন্দুতে মিলিত হয় স্বার্থের লেনাদেনায়। এখানে ধর্ম কোন ফ্যক্টর না।
কাশ্মীরিদের লড়াই কোন ধর্মীয় লড়াই নয়। এটা তাদের অস্বিত্বের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। এখানে ভারতের মত পাকিস্তানও তাদের অস্তিত্বের শত্রু। কাশ্মীরের ইতিহাস একটা জাতিকে দলিত মথিত করে বন্দুকের নলের মুখে দাস বানিয়ে রাখার ইতিহাস। এতে ভারতের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি আছে পাকিস্তানের হাত। আছে বৃটিশদের কুটচাল। আছে একজন বিধর্মী রাজার বিশ্বাসঘাতকতা।
কাশ্মীরিদের মুক্তির লড়াই তাদের নিজেদেরই চালিয়ে যেতে হবে। মুসলমান হিসাবে তথাকথিত মুসলিম উম্মার সাহায্য সহযোগীতা আশাকরা হবে নেহাত বোকামী। তার কিছুটা হলেও লক্ষন পাওয়া যাচ্ছে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বাকি মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা হতে। বাকি বিশ্বের কথা বাদ দিয়ে নিজ ঘরের দিকেই দৃষ্টি ফেরাতে পারে বাংলাদেশের জনগণ। দেশটার ভাড়াটিয়া খুনি বাহিনী র্যাব প্রধান স্বদম্ভে ঘোষণা দিয়েছেন কাশ্মীর প্রশ্নে যারা ভারতের বিরোধীতা করবে তাদের একচুল ছাড় দেয়া হবেনা। স্বদেশীয় এই জল্লাদের আস্ফালন এটাই প্রমান করে হরি সিং'রা মরে না...ওরা বার বার ফিরে আসে...ফিরে আসে ভিন্ন নামে...ভিন্ন চেহারায়।