প্রিয়া সাহার কাছে আমি বিভিন্ন কারণে কৃতজ্ঞ। দেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে লেখালেখি দিয়েই আমার ওয়াচডগি শুরু হয়েছিল। সাল ফাল মনে নেই। পুরানা পল্টনে বোনের বাসায় থাকি, চাকরি করি ধানমন্ডি নতুন ২ নাম্বার রাস্তায়, সোবহানবাগ মসজিদটার পাশে। চাকরি করতে গিয়ে আবিস্কার করি কর্পোরেট দুনিয়ায় আমার ইংরেজী জ্ঞান যথেষ্ট নয়। শুরু হয় ইংরেজী শিক্ষার শাটল মিশন। ভর্তি হই নটেরডেম কলেজের ইংরেজী শর্ট কোর্সে। বাসা হতে তালাক দেই বাংলা পত্রিকা। টিভি চ্যানেলে কেবলই ইংরেজী। নিজের সাথে নিজেই কথা বলি, তাও ইংরেজিতে। নিজের জ্ঞান যাচাই করার জন্যে এনায়েতুল্লাহ খানের সাপ্তাহিক একটা ইংরেজি পত্রিকায় পাঠকের কলামে দু'চার লাইন লেখা শুরু করি। ওখানেই জানতে পারি বিডিআরের রিটায়ার্ড জেনারেল সি আর দত্ত ঐ চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠনের প্রধান। তিনি এক কলামে লিখেছেন সরকার এখুনি ব্যবস্থা না নিলে দেশ খুব শীঘ্রই হিন্দুশুন্য হয়ে পরবে। পাঠকদের মন্তব্যের কলামে কাঁচা ইংরেজিতে আমি লিখলাম, এ দেশের মাটি হতে একজন মানুষও যদি চলে যায় তা হবে ব্লেসিং, রিগার্ডলেস অব হিন্দু অর মুসলিম। ট্রাম্পের মত বলেছিলাম, ভাল না লাগলে হিন্দুদের এ দেশ হতে চলে যাওয়াই ভাল। তাতে আর যাই হোক, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে। আর যাই কোথা! মৌমাছির মত আওয়ামী লীগররা ঝাপিয়ে পরল আমার উপর। বিশেষকরে সংখ্যালঘুর দাবিদার হিন্দুরা। বোকার মত আমার লেখায় ঠিকানা দিয়েছিলাম। হুমকি ঘরের দরজায় এসে পর্যন্ত নক করল। রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে কটা দিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। প্রিয়া সাহার কারণে আজ এসব নিয়ে মুখ খুলতে পারছি।
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের ন'মাস। অনেকের মত আমরাও নিরুর্দ্দিষ্ট হয়ে যাই নিজ শহর ছেড়ে। চলে যাই দাদাবাড়ি। এলাকাটা ছিল অনেকটা দ্বীপের মত। কাছের বাজারে যাওয়ারও একমাত্র রাস্তা ছিল খেতের আইল ধরে হাঁটা। আমাদের মফস্বলের আপন শহর ততদিনে চলে গেছে রাজাকার সহ পাকিস্তানিদের দখলে। আমাদের বসতবাড়ির অর্ধেক উড়ে গেছে ওদের আর্টিলারির আঘাতে।
মার্চ হয়ে এপ্রিল, এভাবে জুন পর্যন্ত কাটিয়ে দেই গ্রামের বনবাদরে ঘুরে। সখেরবশে ফুফাতো ভাইদের সাথে মিলে কবুতরের ব্যবসা শুরুকরি। মাঝে মধ্যে ফসলের মাঠে খাবার নিয়ে যাই কৃষিকাজে নিয়োজিত কামলাদের জন্যে। গরুর কাধে জোয়াল চড়িয়ে কিভাবে চাষাবাদ করতে হয় তার তালিম নেয়ার চেষ্টা করি। এক বিষ্যুতবার হাট হতে ফিরি মহাখুশি হয়ে। কবুতর ব্যবসায় বেশকিছু লাভ করেছি আমি। এখানেই ঘুরে যায় আমার জীবন।
এক সকালে তৈরী হচ্ছি গঞ্জের ওপারে রেলষ্টেশন যাব বলে। ওখানে সস্তায় ঘোড়ায় চড়া যায়। বাবা গম্ভীর গলায় ডাক দিয়ে বললেন, আমি শুনেছি তোমার ব্যবসার কথা। মনেহচ্ছে মাথা আছে তোমার। চলো আমার সাথে, বাজারের ব্যবসায় মন দেবে। বাবাকে না করার মত ইহজগতে কেউ ছিলনা। আমিও পারিনি। সেই হতে প্রতিদিন সকালে রওয়ানা দেই গঞ্জের দিকে। ওখানে আমাদের হরেক রকম ব্যবসা। বাবার সাথে যাই, আবার রাতে ফিরে আসি। দুপুরের খাবার বাড়ির কামলা দিয়ে আসে। উপভোগ করতে শুরু করি নতুন জীবন। এভাবেই চলতে চলতে একসময় বর্ষা আসে। ডুবে যায় গ্রাম-গঞ্জের মাঠঘাট। এখন আর হেঁটে যাওয়া যায়না, যেতে হয় নৌকায় চড়ে।
একদিন লাল রঙের ক্ষয়িষ্ণু একটা বাড়ির সামনে এসে নৌকার মাঝিকে থামতে বললেন বাবা। আমি একটু অবাক হলাম। এ পথে অনেকদিন ধরে আসা-যাওয়া করছি বাবাকে কোনদিন মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেও দেখিনি বাড়িটার দিকে। মনেহল কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
নৌকাটা ঠিক বাড়ির মুল ফটকের সামনে এসে থামল। বাবা আমার দিকে তাকালেন। ভয় পেয়ে গেলাম। গ্রামের দুষ্ট একটা মেয়ের সাথে কিছু একটা হয়ে গেছে আমার, এমন একটা অলীক তথ্য বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভাবলাম হয়ত কিছু শিক্ষা দেবেন। না, তার ধারে কাছেও গেলেন না। কিছু কথা হলো...
- তুমি কি বাড়িটা চেন? কখনো ভেতরে গেছ?
- জমিদার বাড়ি হিসাবে চিনি। ভেতরে যাওয়া হয়নি কোনদিন। ওখানে নাকি শেয়াল-কুকুরদের বাস।
- হ্যা, ওটা জমিদার বাড়ি নিশ্চয়। ওখানে এখন কেউ থাকেনা। সবাই ভারতে চলে গেছে। একটা দারোয়ান আছে পাহাড়ার জন্যে।
- আমরা কি এখন ভেতরে যাব?
- না, তা দরকার নেই। এখানে একটা আইল আছে। শুকনার দিনে দেখা যাবে, এখব ডুবে আছে। এই আইলটা ধরে প্রতিদিন আমি স্কুলে যেতাম। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয় আইল। নিয়ম ছিল কোন মুসলমান বাড়ির সামনে জুতা পরে হাটতে পারবেনা। এখানে আসার আগে জুতা হাতে নিতে হবে।
- এ কেমন আইন? একই দেশে একদল জুতা পরবে, অন্যদল পরতে পারবেনা?
- বাবা আকাশের দিকে তাকালেন। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললনে। মনেহল একদলা কষ্ট বাইরে আনার চেষ্টা করছেন।
- তা আপনারাই বা খুলতে রাজী হতেন কেন?
- এটাই ছিল নিয়ম। শুধু তাই না, স্কুলে আমাদের বসতে হতো মাটিতে পাটি বিছিয়ে। আর হিন্দুদের জন্যে কাঠের টুল। মাঝে মধ্যে আমার বাবাকে ডেকে নিয়ে ওরা ধমকাতো ছেলেকে ইস্কুলে পাঠাচ্ছে বলে। খাঁজনা বাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিত। লোভ দেখাতো বিভিন্নভাবে। বাবা ভয় পাননি। বরং আরও উৎসাহ দিয়ে আমাকে ইস্কুলে পাঠাতেন।
যেদিন ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়ে গেল, প্রথম রাতেই জমিদার বাড়ির সবাই প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেল। ভারত বিভক্তির আভাষ আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল ওরা। তাই গোপনে সহায় সম্পত্তিও বিক্রি শুরু করেছিল। ওরা আমাদের প্রজা হিসাবে মনে করত। আমাদের লেখাপড়া ছিল তাদের অন্যতম প্রধান শত্রু।
বাবার একাডেমিক শিক্ষা কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পেরেছিল তা আমরা কেউ জানতে পারিনি। যে শিক্ষাই থাক তা নিয়েই তিনি ঐ আমলে পার্লামেন্টে বসেছিলেন। ৭১'এ ঐ দিনের পর আর কোনদিন বাবার মুখে জমিদারদের কথা শুনিনি।
প্রিয়া সাহা বিলুপ্ত হিন্দুদের হিসাব দিতে গিয়ে আগের ইতিহাস টেনেছেন। ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন সেই বৃটিশ আমল হতে আমরা তাদের উচ্ছেদ করছি। কিন্তু এই সাহা উচ্ছেদ কাহিনীর সবটা তুলে ধরেননি হয়ত নিজদের কালো ইতিহাস আড়াল করার জন্যে।
মোরাল অব দ্যা স্টোরি ইজ, অত্যাচারীরা এভাবেই বিলুপ্ত হয়। ইতিহাস তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং তারা সে পথে হাটতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের হিন্দুদের সবাই অত্যাচারী ছিল তা সত্য নয়। কিন্তু অনেকেই ছিল। এবং এই তারাই ধর্ম ভিত্তিক বিভক্তির প্রথম বীজ বপন করেছিল এ দেশে।
জেরুজালেম, ২৫ শে জুলাই। ২০১৯ সাল।