বাংলাদেশের যে শহরে আমার জন্ম এবং যেখানে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়েছি সে শহরে সংখ্যালঘু হিন্দুদের একটা সময় বেশ প্রাধান্য ছিল। স্কুলে আমার ক্লাসে আমরা ছিলাম ২০ জন মুসলমান এবং ১৭ জন হিন্দু। ঐ বয়সে হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য আমাদের কেউ বুঝাতে আসেনি। বড় হয়েছি সরস্বতী পূজার সাথে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। স্কুলে শিক্ষকদের শতকরা ৮০ ভাগ ছিলেন তারা। আমরা ধর্ম নিয়ে ত্যানা পেচায়ইনি। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমাদের বাসায় এসে প্রাইভেট পড়াতেন। এবং তা বছরের পর বছর। ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও পারিবারিক যে কোন সেলিব্রেশনের ছিলেন স্থায়ী অতিথি। সেই স্যার একদিন আমাদের ভাই-বোনদের নিমন্ত্রণ করলেন ওনার বাসায়। কারও মুখাগ্নি না কি যেন একটা ছিল। বেশ আদর করে খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে প্লেট গুলো উঠিয়ে সোজা ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। আমি থ। কাঁচের প্লেট ডাস্টবিনে! হিসাবটা মেলাতে কষ্ট হলো। সে সময় দেশে কাগজের প্লেট বাজারে আসেনি। ঘটনাটা আমার মাথায় গেঁথে গিয়াছিল, এবং উত্তর খুঁজতে অনেকের কাছে ধর্না দিয়েছিলাম। আমার ক্লাসমেটের কাছেই পেলাম উত্তরটা। যে প্লেটে মুসলমানরা খায় হিন্দুদের জন্যে সে প্লেট আর নাকি পবিত্র থাকেনা। ম্লেচ্ছ হয়ে যায়। স্যার জাতে ছিলেন ব্রাহ্মণ। কোথায় কি যেন একটা সমস্যা ছিল আমাদের খাওয়া প্লেট নিয়ে। কোন এক সুন্দর সকালে ঘুম ভাঙ্গতে শুনি স্যার সপরিবার 'গুম' হয়ে গেছেন। এবং পরিবর্তীতে উনাকে আবিষ্কার করা হয় কোলকাতার কোণ এক এলাকায়। গোপনে সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গেছেন পছন্দের দেশে।
শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের শতকরা ৮০ ভাগ ছিল হিন্দুদের। এ নিয়ে কারও কোন অভিযোগ কোনদিন শুনিনি। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। আমার লম্বা প্রবাস জীবনের কোন এক ফাঁকে ৫টা বছর দেশে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। তাও মফস্বলে আমাদের শহরে। টেক্মটাইল ছিল আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। সেই পাকিস্তান আমল হতে। ব্যবসার গ্রাহকদের প্রায় সবাই ছিল সংখ্যালঘু হিন্দু। বাকিতে ব্যবসা করার রেওয়াজ আমাদের এলাকায় অনেক পুরানো। সবাই তাই করে। কোন এক সুন্দর সকালে গরম এক খবরে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। আমাদের মূল গ্রাহকদের একজন প্রায় ৬০ লাখ টাকা বকেয়া রেখে 'গুম' হয়ে গেছেন। একবারে উধাও উথাউট এনি ট্রেইস! সেদিনের ৬০ লাখ আজকে হিসাবে বেশ কয়েক কোটি টাকার হবে। আমাদের মাথায় হাত...হাতে হারিকেন! খোজ নিয়ে জানা গেল ভদ্রলোক এমন আরও অনেকের অর্থ আত্মসাৎ করে স্বপ্রনোদিত গুম হয়ে গেছেন পছন্দের দেশে।
যদি ৩ কোটি ৭০ লাখ গুমের সংখ্যাটা সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এ সংখ্যায় আমার প্রিয় শিক্ষক ও এককালের বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীও থাকবেন। Just a FYI...
তেল আবিব। ২২শে জুলাই।