ইমিগ্রন্টদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগের অন্ত নেই। প্রতিদিনই তিনি এ দেশে পা রাখা বৈধ-অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন অভিযোগ আনছেন। দেশটার দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার দেশ হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা ও এল সালভাদর হতে যারা আসছে তাদের সবাই নাকি ধর্ষক, খুনি, ড্রাগ ডিলার, হিউম্যান ট্রাফিকার। এদের ইন-ফ্লাক্স কি করে রোধ করা যায় এটাই এখন ট্রাম্পের পুনঃ-নির্বাচনের মূল এজেন্ডা। হোয়াইট হাউস হতে লিক হওয়া খবরে প্রকাশ; প্রেসিডেন্ট সীমান্ত বরাবর লম্বা, উঁচু দেয়ালের পাশাপাশি খালকেটে তাতে হিংস্র সাপ ও কুমীর ছেড়ে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তার উপদেষ্টারা তাতে সায় না দেয়ায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
আমি থাকি নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে। মেক্সিকো সীমান্ত এখান হতে ৪ ঘণ্টার ড্রাইভ। গোটা অঙ্গরাজ্যেই মেক্সিকান ইমিগ্রান্টদের দাপাদাপি। দৈনন্দিন জীবনের প্রতি ধাপে ওদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। স্প্যানিশ ভাষার ব্যবহারও এখানে সার্বজনীন। আমার দুই সন্তানও রপ্ত করছে এই ভাষা। ব্যপারটা এমন নয় যে দুর্গম মরু-পথ পাড়ি দিয়ে যারা আসছে তাদের দুয়েকজন অপরাধ কার্যক্রমের সাথে জড়িত নয়। তাই বলে ইমিগ্রান্টদের গোটা কাফেলাই ধর্ষক আর খুনি এ অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। এর পক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন প্রমাণই দাঁড় করাতে পারেননি।
ইমিগ্রান্টদের ব্যপারে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হচ্ছে অনেকটা কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী কবিতার মত...ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়েছে তা ভরি...। আসলেই কি তাই?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্রান্টদের দেশ। ট্রাম্পের পূর্বপুরুষেরাও একই পথের পথিক। জার্মানি হতে এ দেশে এসেছিল ভাগ্যের সন্ধানে। প্রেসিডেন্টের চতুর্থ স্ত্রী প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রান্ট, যিনি এখনো ভাল ইংরেজি শিখে উঠতে পারেননি। আদিবাসী আমেরিকানদের কচুকাটা করে সাদা ইউরোপিয়ানরা এদেশে নিজেদের আস্তানা গেড়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পর বৈধতা দিয়েছিল ইমিগ্রান্টদের আগমনে। তারই সূত্রধরে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে আমার মত কোটি কোটি মানুষ এ দেশে আসছে এবং অবদান রাখছে দেশটার অর্থনীতিতে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত উগ্র সাদাদের অনেকে সন্তুষ্ট নয় ইউরোপ বাদে পৃথিবীর বাকি অংশ হতে ইমিগ্রান্টদের আগমনে। সন্দেহ নেই যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে সাদারা এ দেশে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। সমস্যা হচ্ছে, এ দেশের শাসনতন্ত্রে সাদাদের এমন কোন নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি যার বলে তারা আজীবন এদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ডমিনেট করবে। এখানেই আসে খুনি আর ধর্ষকদের জুজুর ভয়।
ট্রাম্প সরকার কেবল দক্ষিণ সীমান্তের কাফেলাই নয়, এতদিন যারা বৈধ পথে আসছিলো তাদেরও ঠেকানোর চেষ্টা করছে। এই যেমন; নাগরিকত্ব নেয়ার পর নিজ পিতা-মাতা ও সিবলিংদের মাইগ্রেট করার অধিকার। এমনকি যারা ইতিমধ্যে স্থায়ী নাগরিক হিসাবে বাস করছে তাদের আমেরিকান নাগরিক হওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়া। চেষ্টা চলছে অনেক ফ্রন্টে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। কারণ এ দেশে প্রেসিডেন্সি মানেই বাংলাদেশের মত পৈত্রিক-সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নয়। এখানে আছে ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স। তিনটি শাখা মিলেই এখানে ক্ষমতা; লেজিস্লেটিভ, এক্সিকিউটিভ ও জুডিশিয়ারি। এখানে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। খোদ প্রেসিডেন্টও এখানে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। তার সব কর্ম-অপকর্মের জন্যে কংগ্রেসের কাছে জবাব দিতে হয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হিসাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্সি মানেই সৌদি রাজতন্ত্রের ক্ষমতা, রুশ একনায়কতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা, উত্তর কোরিয়ার ডিক্টেটরিয়াল টাইপে প্রতিপক্ষ নিধনের নিশ্চয়তা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক আমেরিকায় এ অধিকার কোন প্রেসিডেন্টের জন্যেই কোনদিন নিশ্চিত করা হবেনা। এক সময় হিটলারও এ পথে হেঁটেছিলেন। নিজদের গায়ের রঙ ও রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে রক্তবণ্যা বইয়ে দিয়েছিলেন পৃথিবীতে।
বর্নবাদের উত্থান নিয়ে পৃথিবী যদি এখনই সজাগ না হয়, তাহলে এর মূল্য শোধ করতে হবে কড়ায় গন্ডায়। যেমনটা করেছিল গেল শতাব্দির চল্লিশের দশকে ইউরোপীয়ানরা।