মার্চের শেষ সপ্তাহে ইপিআর ও সেনাবাহিনীর কিছু দলছুট জওয়ান দখল নেয় আমাদের শহরের। ওরা জীপে করে টহল দিতে থাকে শহরের অলিগলি। বিভিন্ন পয়েন্টে বাঙ্কার খুড়ে প্রস্তুতি নেয় সন্মুখ যুদ্ধের। অনেককিছু বুঝার বয়স তখনও হয়নি। কিন্তু একটা জিনিষ বুঝতে অসুবিধা হয়নি সামনের সময়গুলো ভাল যাবেনা এবং সহসাই আমার স্কুলে ফেরা হবেনা। বিপদ আঁচ করতে পেরে আব্বা সবাইকে দাদাবড়ি পাঠিয়ে দেন। তাও খুব একটা দূরে না।
এপ্রিলের প্রথমে সপ্তাহে পাকিস্তানি বোমারু বিমানের আঘাতে ঘুম ভাঙ্গে শহরবাসীর। দুই দিনের বোমা বর্ষণে মাটির সাথে মিশে যায় শহরের মূল বাণিজ্যিক কেন্দ্র। দাদাবাড়ি হতে ঘণ্টা দুয়েক দৌড়ে শহরে পৌঁছে দেখি বদলে গেছে অবস্থা। গোটা শহরজুড়ে চলছে লুটতরাজ। আওয়ামী লীগের হেভি-ওয়েট নেতা যারা এতদিন ইপিআরের জীপে চড়ে বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়িয়ে শহরময় রাজত্ব করতেন তাদের অনেককেই দেখলাম ব্যাংক লুটছে। বড় বড় ব্যবসায়ীদের গুদাম ভেঙ্গে ঠেলাগাড়িতে করে মাল পাচার করছে। আমাদের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কেবল কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করতে পেরেছিলাম সবাই মিলে। মজুত মালামাল ও নগদ চোখের সামনে লুটে নিলো একদল হায়েনা। রাজ্যের ক্লান্তি, হতাশা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা ফিরে গেলাম দাদাবড়ির দিকে। ওখানেই কাটবে বাকি আট মাস।
পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে আমাদের বাড়ির একাংশ উড়ে গিয়েছিল। যদিও ঐ সময় বাসায় কেউ ছিলনা। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলে যায়। গোটা শহর চলে যায় পাকিস্তানীদের দখলে। গড়ে উঠে শান্তি বাহিনী। জয়বাংলা শ্লোগানের মহান সৈনিকদের অনেকে ডিগবাজি খেয়ে চলে যায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। শহরের হিন্দু সম্পত্তি সামান্য সাদা চকের কারসাজিতে দখল নিয়ে খুলে বসে ব্যবসা বাণিজ্য। আমাদের মূল বাড়ি তখনো পরিত্যক্ত। কেয়ারটেকার গিয়াস উদ্দিনই দেখভাল করছে একসময়ের জমজমাট বাড়িটা।
জুনের মাঝামাঝি কাউকে কিছু না বলে আমি চলে আসি শহরে। ইচ্ছা ছিল বাসা হতে কিছু বই ও ক্রিকেট খেলার সরঞ্জামাদি নিয়ে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরে যাব। বাড়ির মুল ফটক খোলা দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। ভয়ে অনেকটা গেরিলা কায়দায় পিছনের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। গিয়াস উদ্দিনের ছায়াটা পর্যন্ত নেই। অথচ সব ঘরের দুয়ার খোলা। নিজের বিছানায় গা এলিয়ে সাতপাঁচ অনেক কিছু চিন্তা করছি। এমন সময় মুল ফটক খোলার আওয়াজ পেয়ে উঠে বসলাম। ফটকের নীচে একজোড়া বুট ও উপরে লম্বা একটা বেয়নেট দেখে শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। কেউ একজন ঢুকছে!
গিয়াস উদ্দিন। আমাদের কেয়ার টেকার। হাতে রাইফেল। আমাকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ... মামা, আমি রেজাকারে নাম লেখায়ছি। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানালো, বেশকিছু নগদ দরকার তার। নামে রাজাকার হলেও মুল কাজ নাকি রাতের অন্ধকারে লুটপাট। বাসার পঞ্চাশ বছরের পুরানো দেয়াল ঘড়িটার কথা জিজ্ঞেস করতে জানালো তার কমান্ডারের নাকি পছন্দ, তাই নিয়ে গেছে।, কথা না বাড়িয়ে সব ঘরে তালা লাগিয়ে ফিরে গেলাম মেঘনা পাড়ে। ফিরে যাওয়ার ও পথটা ছিল নিরাপদ। যদিও গিয়াস উদ্দিন চাইছিল তার হেফাজতে আমি দাদাবাড়ি ফিরি।
১৬ই ডিসেম্বরের পর গিয়াস উদ্দিনের আর কোন খরব পাইনি। অনেকের মতে তাকে নাকি মেরে শহরের মোড়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার ও ঘড়ি চোর গিয়াস উদ্দিন রাজাকারের নাম সরকারের সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় আছে কিনা বলতে পারবোনা। তবে এ বলতে পারবো, যারা সেদিন চোখের সামনে আগুনের লেলিহান ঠেলে গুদাম ভেঙ্গে আমাদের সর্বস্বান্ত করেছিল তাদের অনেকে পরিবর্তীতে জয়বাংলার মুক্তিসেনা সেজেছিল। আর যারা ব্যংকের ভল্ট ভেঙ্গে বড় ধরণের দাও মেরেছিল তারা বনে গিয়েছিল শিল্পপতি, মুক্তিযুদ্ধের ধারক, বাহক। এক সময় সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে বসেছিল ক্ষমতার অনেক উঁচু আসনে। পার্লামেন্টে বসে হুংকার দিয়েছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে।
গেল আটচল্লিশ বছর ধরে এসব জুচ্চুরি দেখছি আর সহ্য করছি। ৭১'এর লাম্পট্যকে ১৬ই ডিসেম্বরের বুলি কপচিয়ে হালাল করার নেংটা প্রচেষ্টা মেনে নিচ্ছি স্বাধীনতার নামে। জন্ম যাদের চুরি আর লুটের জরায়ুতে তাদের মুখে বিজয় দিবসের লম্বা লম্বা বয়ান মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলায় শোনা আবুল বয়াতির পালা গানের কথা।
তার গানের দুটা লাইন এখনো মনে আছে...
মদ কি মজার জিনিস
বানাইয়াছো জগদিশ
আমারে ইট্টু বেশি দিস
কম দিস না...