মধ্য ডিসেম্বরের রাত। প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে মাসের শুরু হতে। জনজীবন একেবারেই অচল। স্কুল, কলেজ, দোকানপাট সব বন্ধ। তাপমাত্রা - ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে উঠা-নামা করছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। বছরের এ সময়টায় পৃথিবীর এ অংশে এ ধরণের আবহাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বরং উলটো হলে স্থানীয়দের সবাই আক্ষেপ করে। সেন্ট পিটার্সবার্গ এমনিতেই আমার দেখা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর শহর। তার উপর তুষারের আচ্ছাদনে শহরকে রূপকথার কল্পরাজ্যের মত দেখাচ্ছিলো।
শনিবার রাতটা এমনিতেই রুশদের জন্যে উপভোগের রাত। তার উপর শীতের ভয়াবহতা এনে দিয়েছিল শরীর গরম করার লোভনীয় সুযোগ। ভদকা! একটা জাতির জন্ম, এর বিবর্তন ও সমাপ্তির সবটাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা ছিল ভদকার করাল থাবা। একটা শিশুর জন্ম নেয়ার আনন্দ যেমন উৎযাপন করা হতো ভদকা দিয়ে, তেমনি তার বড় হয়ে পৃথিবী হতে বিদায় পর্বেও থাকতো ভদকা। এমনকি মৃত একজনের জন্মদিন পালনের বলি হিসাবে কবরে রেখে দেয়া হত শক্তিশালী এই এলকোহল। রুক্ষ আবহাওয়া এসবের জাস্টিফিকেশন হলেও আসলে রুশরা জন্ম নিত রক্তে ভদকার নেশা নিয়ে। । শীতের সে রাতে নেশার নহর বয়ে গিয়েছিল রুশদের ঘরে ঘরে।
বিদেশি হিসাবে আমরাও এই নেশার আওতামুক্ত ছিলাম না। অনেকে রুশদের সাথে পাল্লা দিয়ে একধাপ এগিয়েও গিয়েছিল। আমার বন্ধু বাহার ছিল তাদেরই একজন। এ কাজে ও ছিল আমার ওস্তাদ। যদিও সে ছিল আমার এক বছরের জুনিয়র। ছাত্র হিসাবে আমরা দুজনই ছিলাম স্বনামধন্য। দুজনের ছবিই শোভা পেত কলেজের ভাল ছাত্রদের বোর্ডে। তাছাড়া আমরা দুজনেই ছিলাম অতিরিক্ত ষ্টাইপেন্ড ভোগী। তবে আমাদের দুজনেরই কিছু 'কালো' দিক ছিল তা বাইরের কেউ জানতো না। এই যেমন শনিবারের নৈশ অভিযান।
প্রতি শনিবারের মত সে রাতেও আমরা তৈরি ছিলাম। সময় মত দু'জন অনিত্য সুন্দরী রুশ ললনা এসে আমাদের ডাক দিল নিষিদ্ধ জীবনে। শহরের ক্লাব, বার গুলো খোলা থাকলেও ওখানে যাওয়ার সুযোগ ছিলনা। রাস্তা-ঘাট ড্রাইভ করার উপযুক্ত ছিলনা। মেট্রো-রেল পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার মত শারীরিক ও মানসিক শক্তিরও ছিল ঘাটতি। আমাদের ডর্মে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো ছিল নিষিদ্ধ। মূল কারণ রুশরা। তাদের সবাই ছিল ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর স্যাকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট। কঠোর আইনে আটকে রেখে মানুষ করা হচ্ছিল তাদের। উপায় না দেখে পাশের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢুঁ মারার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওখানকার বেইজমেন্ট সবসময় খালি থাকে এবং সেখানে সেন্ট্রাল হীটিং সিস্টেমও সচল। ললনাদের কোন আপত্তি ছিলনা। ওরা নরকে যেতেও রাজী ছিল মধ্যরাতের ভদকার জন্যে।
চারদিক শুনশান। ভয়াবহ নীরবতা। বরফের উপর হাটতে গেলে মচ মচ আওয়াজ হয় কেবল। খুব সাবধানে দরজা খুলে আলতো করে ঢুকে পরলাম। কথায় বলে, যেখানে রাত, সেখানেই বাঘের ভয়! এ যাত্রায় তাই হলো। মূল ফটকেই দেখা বাহারের রুশ ক্লাসমেট আলেক্সেইর সাথে।
এই আলেক্সেইর উপর একটা সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দিল বাহার। ও ব্যাটা আগাগোড়া বর্ণবাদী। বিদেশি কাউকে রুশ মেয়েদের সাথে দেখলে রেগে আগুন হয়ে যায়। এমন গহীন শীতের রাতে এসব নিয়ে ভাবতে চাইলামনা না। তবে ভাবনায় ছেদ পরতে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। রুশ মিলিশিয়া!
ওরা গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। দু'জন ভেতরে ঢুকে আমাদের বেসামাল অবস্থায় দেখে তাদের সাথে ষ্টেশনে যাওয়ার আদেশ দিল। কোন শব্দ ব্যায় না করে হুরমুর করে উঠে পরলাম গাড়িতে। ঘূর্ণায়মান লালবাতি জ্বালিয়ে আমাদের নিয়ে এগিয়ে গেল তাদের আড্ডায়।
'তা তোমার নাম কি? - জিজ্ঞেস করতে বাহারের দিকে তাকালাম আমি। সেও তাকাল। যা বুঝার তা আমরা দুজনেই বুঝে নিলাম।
'আমার নাম, তুই খাঙ্কির পোলা'। বলেই হাসিটা চেপে রাখলাম। ওরা একটা ফর্ম ফিলাপ করে ওখানে আমাকে সই করতে বললো। দাপটের সাথে সই করলাম। ওরা জানতো আমাদের বাস পাশের ডর্মে। তাই এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলোনা।
এবার বাহারের পালা।
'তা তোর নাম কি মাতালের দুলাভাই?
'আমার নাম, তুই শুয়রের বাচ্চা'
ওকেও কাগজে সই করতে বাধ্য করলো।
রাত দু'টার দিকে নৈশ অভিযান শেষে ডর্মে ফিরে এলাম। সকালে সবকিছু মনে করতে অসুবিধা হল। তাও সেই ভদকার কারণে। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস চলে গেল। স্মৃতির পাতা হতে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসলো সে রাতের ইতিহাস।
শীতের প্রকোপ বেশকিছুটা কমে গেছে। রাস্তায় মানুষ চলাচল শুরু হয়েছে। মস্কো হতে ক'জন বড়ভাই এসেছেন আমাদের এখানে। তাদের নিয়ে চারদিক ঘুরছি। নারভস্কায়া নামের একটা পাতাল রেলের ষ্টেশনে সদলবলে ঢুকতে যাচ্ছি।
রুশ মিলিশিয়া! ওরা দু'জন সামনে এলো। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে মনে করিয়ে দিল সে রাতের কথা...।
'কিরে, তুই খাঙ্কির পোলা, কেমন আছিস? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
অন্যজন বাহারের দিকে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'তুই শূয়রের বাচ্চা, কেমন আছিস?
আমাদের দুজনকেই ধন্যবাদ দিল সে রাতে দুজন সুন্দরী রুশ ললনা উপহার দেয়ার জন্যে।
সাথে বড়ভাই ও তাদের স্ত্রীরা সবাই বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ!