এক পশলা বৃষ্টি, সাথে ঘণ্টায় ৭০ মাইলের ঝড়ো বাতাস রাতারাতি পালটে দিল প্রকৃতির মতিগতি। বুধবার দুপুর পর্যন্ত মাথার উপর সূর্যের দাপট ছিল অসহনীয়। তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে খা খা করছিল আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের এ অঞ্চল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সাথে সাথে বদলে গেল সবকিছু। দলা দলা ঘণ কালো মেঘ দৈত্যের মত গিলে ফেললো গোটা আকাশ। সন্ধ্যা নামার সাথে শুরু হল মরু বাতাস। ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতির বাতাস এ অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। সপ্তাহে অন্তত ২/১ দিন এ বাতাসকে স্বাগত জানাতে হয়।
রুক্ষ্ম আবহাওয়ার সাথে কম্প্রোমাইজ করেই বাস করতে হয় আমেরিকার এ অঞ্চলে। রাত গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করলো বাতাস। দ্রুত নেমে যাওয়ার সংকেত দিল বাইরের প্রকৃতি। ঘরে বসেই বুঝা গেল কতটা নীচে নেমে গেছে বাইরের তাপ মাত্রা। মোবাইল ফোনের দিকে তাকাতেই আতকে উঠলাম...মাত্র ৫ ডিগ্রী। বাসার এসির থার্মোষ্ট্যাট ঘুরিয়ে হীটার চালুর তাগাদা অনুভব করলাম। তা করতে গেলাম না,কারণ দু'দিন পর তাপদাহ ফিরে আসবে এ ব্যপারে সন্দেহ ছিলনা।
অতিরিক্ত একটা হীটার ছিল, তাই চালু করে সবাই এক রুমে রাতা কাটানোর সিদ্বান্ত নিলাম। মেয়ে নিজের রুমে রাত থাকতে ভয় পাচ্ছিলো। বাসার পেছন দিকের হাই ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইন হতে ভীতিকর সব শব্দ ভেসে আসছিল। বাতাসে কাঁপছিল গোটা নেটওয়ার্ক।
আর দশটা সকালের মতই ছিল আজকের সকাল। তবে প্রকৃতির দিকে তাকালে মন হবে শরতের শেষে ঝাঁকিয়ে শীত নেমেছে। গাছপালা সহ সবুজের বাকি সমারোহ লন্ডভন্ড হয়ে আছে। বাতাসের তীব্রতা কমে আসলেও একেবারে থেমে যায়নি। উঠিয়ে রাখা শীতের পোশাক হতে পুরো একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে অফিস করতে নীচে নেমে গেলাম।
কর্পোরেট আমেরিকায় আজ আর মনযোগ দেয় হলনা। কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতা চেপে বসেছে। মগজ হতে তা নামানো গেলোনা। অনেকদিন পর বাড়ির কথা মনে পরলো। মনে পরলো মা'র কথা। নষ্টালজিক হয়ে জানালার পাশে বসতে অনেকটা ভিডিও রিওয়াইন্ড করার মত দৃশ্যপট রিওয়ান্ড করে মত ফিরে গেলাম যুদ্ধের মাসগুলোতে।
দাদাবাড়িতে আমরা। শহর হতে অনেকদূরে। ঐ দিকটায় বিদ্যুৎ তখনো দিবাস্বপ্ন। দশ মাইল হাটার পরই কেবল গাড়িঘোড়ার সাক্ষাত পাওয়া যায়। যে ঘরটায় আমি থাকি দক্ষিনের জানালা খুললে মাইলের পর মাইল কেবল ফসলের মাঠ। কান পাতলে শোনা যায় সোনালী ধানের কলতান। দূরের মদনগঞ্জ রেললাইনে তখনো ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। উত্তর-পূব কোন ঘেঁষে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। নদীতে নৌকার কাফেলা হরেক রঙের পাল উড়িয়ে চলে যাচ্ছে গঞ্জের দিকে। সপ্তাহের একদিন হাঁট জমে ওখানে। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আমিও চলে যেতাম। উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো, রাস্তার হোটেলে মাটিতে বসে দুপুরের ভাত খাওয়া...দিনশেষে একজোড়া কবুতর কিনে বাড়ির দিকে রওয়ান দেয়া...। সবই ছিল এলোমেলো। তবে এ নিয়ে কোন অভিযোগ ছিলনা। কষ্ট ছিল স্কুলকে নিয়ে। চাইলেও একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা আমাদের। এপ্রিলের শুরুর দিকে আমাদের শহর ক্ষতবিক্ষত হয় শত্রূর বিমান হামলায়। কিছুদিন পর সেখানে উদয় হয় স্থল সেনা। কামানের গোলায় আমাদের বাড়ির একাংশ উড়ে যায়। শহরে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন যেন সেখানেই সমাহিত হয়ে যায়।
অনেকের মত আমার বিশ্বাসেও ফাঁটল ধরতে শুরু করেছিল। অস্থির অনিশ্চিত অবস্থার কোন শেষ আছে বলে মনে হলনা। সময় বয়ে যায়...ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাই...। গরমের পর শীত আসে...বর্ষার পর বসন্ত, কিন্তু আশার কোন আলো দেখা যায়না।
একবিংশ শতাব্দির এ সময়টা কেন জানি ৭১'এর সময়গুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। করোনাকে মনে হয় পাকিস্তানি ভূত। ভূতের ভয়ে নয় মাস লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল দাদাবাড়িতে। করোনা বয়সও নয় মাস হতে চললো। আগের মতই জীবন এখন স্থবির। চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা।
ডিসেম্বরের শুরুতে বাতাস বদলাতে শুরু করেছিল। গঞ্জের দিকে গেলে শোনা যেত আর বেশি দেরী নেই। মুক্তি ছিল সময়ের ব্যপার মাত্র। করোনা মুক্তি আশা এখনো স্বপ্নের মত। তবে সে আশা একেবারে নির্বাসনে গেছে বলা যাবেনা। কোথাও কোথাও নিশ্চয় তা মিট মিট করে জ্বলছে।