১৯৮৬ সাল। গ্রীষ্মের ছুটিতে সে বছর আমি ইংল্যান্ডে। সাউদ ডেভনশায়ারের ছোট শহর পেইনংটনের একটা রেস্টুরেন্টে সামার যব করছি। সে বছর আটলান্তিকের ওপারের দেশ মেক্সিকোতে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল মেলা। ফুটবল পাগল বৃটিশরা উত্তেজনায় কাঁপছে তাদের দল নিয়ে। ২২শে জুনের সন্ধ্যায় (বৃটিশ সময়) মেক্সিকো সিটির আজটেকা ষ্টেডিয়ামে শুরু হল টুর্নামেন্টের কোয়াটার ফাইনাল। প্রতিদ্বন্ধি,আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড। কিসমত নামের রেষ্টুরেন্টে সে রাতেও আমার কাজ ছিল। স্থানীয় দুজন ওয়েটার ছুটি নিয়ে টিভির সামনে বসে গাছে। ২০ বছর বয়স্ক পাকিস্তানী মালিকও কাজে আসেনি। কিচেনে ভারতীয় শেফ এবং সামনে একা আমি। দোতলা বিল্ডি'এর নীচ তলায় রেষ্টুরেন্ট এবং উপর তলায় ষ্টাফ কোয়ার্টার।ওখানে টিভি চালু করে নীচে কাজ করছি। শরীর কাজে থাকলেও মন ছিল উপর তলায় টিভির সামনে। টিভির ভ্ল্যুম ছিল উঁচুতে। একটু জোরে শব্দ শুনলেই উপর দৌড়ে গিয়ে বুঝার চেষ্টা করতাম কি ঘটছে খেলায়।
এবং এ খেলায়ই ঘটে ছিল ম্যারাডোনার সেই ঐতিহাসিক গোল। হ্যান্ড গোল। হাত দিয়ে গোল করে পার পেয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত জিতে ছিলেন ২-১ গোলে। ইংল্যান্ডে থাকায় স্বভাবতই সে দেশের সমর্থক ছিলাম। টিভির সামনে দাঁড়িয়ে থঁ হয়ে গিয়েছিলাম এহেন গোল দেখে। ভুলেই গিয়েছিলাম নীচে আমার চাকরিস্থল।
বেশকিছুটা সময় পর ফ্লোরে ফিরে এসে মাথায় হাত! কাউন্টারের বার হতে ১ বোতল ভদকা ও ১ বোতল আইরিশ হুইস্কি হাওয়া! চোখে অন্ধকার দেখলাম। পাশের আরেক রেষ্টুরেন্টে কর্মরত বন্ধু হাসানকে ফোন দিলাম। সে-ও সে রাতে ছুটি নিয়েছিল। পাশের শপিং মল হতেনতুন দু'বোতল কিনে আনলো আমার জন্যে। আমি কোন ট্রেইস না রেখে প্রতিস্থাপন করলাম চুরি যাওয়া ভদকা ও হুইস্কি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে শেষ করলাম সে রাতের ঘটনাবহুল কাজ।
সমস্যা দেখা দিল দু'দিন পর। পাকিস্তানী মালিক সাইদ লক্ষ্য করলো ব্যপারটা। দুটো বোতলই ভদকা ও হুইস্কি ভরা। অথচ চুরি যাওয়া বোতলগুলো ছিল আধা খালি। কোন কিছু না লুকিয়ে খুলে বললাম সে রাতের কাহিনী। দরজা ছিল খোলা। রেষ্টুরেন্টের সামনে আমার থাকার কথা থাকলেও আমি ছিলাম উপর টিভির সামনে। অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে ভেতরে ঢুকে কেউ চুরি করেছে বোতল দুটো। সাইদ টাকা ফেরত দিতে চাইলো। আমি অস্বীকার করলাম। এ নিয়ে প্রায়ই তার সাথে তর্ক হতো। গ্রীষ্মের শেষে যেদিন আমি ফেরার রাস্তা ধরলাম জোর করে আমার পকেটে ধরিয়ে দিয়েছিল বেশকিছু পাউন্ড।
যে রাতে ম্যারোডোনার হ্যান্ড গোলে ইংল্যান্ড হেরে গিয়েছিল পরের দিন গোটা বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ ছিল উত্তাল। দেশটার দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় জ্বল জ্বল করছিল ম্যারাডোনা ও তার হাতের 'কারুকার্য'। ম্যারাডোনা প্রসঙ্গ উঠলেই আমার স্মৃতির পাতায় হানা দেয় সে রাতের ঘটনা।
ম্যারাডোনার পরিণতি কোন দিকে যাচ্ছে বুয়েনস আয়ার্স হতে একজন ফোন করে আমাকে আগেই জানিয়েছিল। ড্রাগাসক্ত ম্যারাডোনা নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিলেন উদাসীন। নিজকে ভোগের সমুদ্রে ভাসিয়ে জীবন উপভোগকরে গেছেন। অনেক সেলিব্রেটির মত দিয়েগো ম্যারাডোনাও নিজের ফেইম সোজা পথে হজম করতে পারেননি।
কোটি মানুষের প্রিয় দিয়েগো...যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।