জিম জোনসের কথা কি আপনাদের মনে আছে? মনে আছে ১৯৭৮ সালের ১৮ই নভেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা? শ্বাসরুদ্ধকর সে ঘটনা গোটা বিশ্বকে কদিনের জন্যে প্যারালাইজড করে রেখেছিল। ঘটনার প্রেক্ষাপট জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে আরও অতীতে। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকো হয়ে ফিরে যেতে হবে আরও পূবে ইন্ডিনায়ানা অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিয়ানাপোলিস শহরে। ১৯৫৫ সালে ওখানেই জন্ম হয় পিপলস টেম্পলের। জন্মদাতা জিম জোনস। 'Apostolic Socialism' ধ্যান ধারণার মূল ভিত্তি ছিল "those who remained drugged with the opiate of religion had to be brought to enlightenment—socialism."। আমেরিকার দক্ষিণের ধর্মভীরু অঙ্গরাজ্য ইন্ডিয়ানা ভালভাবে নেয়নি জোনসের এসব প্রচারণা। শুরু হয় এলাকা ছাড়ার সরকারী চাপ। চাপ সইতে না পেরে অনুসারীদের নিয়ে জিম জোনস পাড়ি জমান পশ্চিমের সানফ্রানসিসকো শহরে। এ শহরেই জন্ম নেয় পিপলস টেম্পল এগ্রিকালচারাল প্রজেক্ট।
নামে কৃষি প্রকল্প হলেও খুব অল্প সময়ে জিম জোনস জড়িয়ে যান স্থানীয় রাজনীতিতে এবং আবির্ভূত হন প্রভাবশালী শক্তি হিসাবে। পাশাপাশি বাড়তে থাকে তার ভক্তের সংখ্যা। ১৯৭৩ সালের শরতের শেষ বেলায় স্থানীয় এক পত্রিকা কৃষি প্রকল্পের আড়ালে জিম জোন্সের অবৈধ কার্যকলাপের লম্বা এক ফিরিস্তি তুলে ধরে। জিম বুঝতে পারেন আমেরিকায় তার অস্তিত্ব বিপদের মুখে পরতে যাচ্ছে। আস্তানার জন্যে খুঁজতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়। তালিকায় আসে ব্রাজিলের গহীন জঙ্গল, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের নির্জন কোন দ্বীপ, এমনকি প্রতিবেশী দেশ কানাডার নাম। কিন্তু জিম জোনস বেছে নেন দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিক পাড়ের দেশ গায়ানা।
গায়ানা বেছে নেয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধী প্রত্যাবর্তন চুক্তি। তাছাড়া গায়ানার তৎকালীন সরকার ছিল সমাজতান্ত্রিক ঘেঁষা এবং দেশটায় ছিল কালো গায়ানীজদের সস্তা শ্রম। জোনস স্থানীয় সরকার প্রধানকে বুঝাতে সক্ষম হন বিতর্কিত গায়ানা-ভেনিজুয়েলা সীমান্তে আমেরিকানদের উপস্থিতি গায়ানার জন্যে কৌশলগত শক্তি হিসাবে কাজ করবে। প্রাথমিক বুঝাপড়া ও সমীকরণ মেলানোর পর পল্লবিত হতে শুরু করে জোনসের কম্যুউন বেইজড কৃষি প্রকল্প। তার অনুসারীরা দলে দলে পাড়ি জমাতে শুরু করে গায়ানার। এক সময় জোনসের আস্তানার নামকরণ করা জোনসটাউন হিসাবে। ১৯৭৪ সালে গায়ানীজ সরকার ৩০০০ একর জমি লীজ দেয় জোনসটাউনের নামে। জোনস এই শহরকে সমাজতন্ত্রের স্বর্গ হিসাবে ঘোষণা দেয়।
বর্ণবাদ ও অর্থনৈতিক অসমতার শিকার অনেক আমেরিকান পাড়ি
জমায় জোনসের কথিত সমাজতান্ত্রিক সমতার লীলাভূমিতে। জোনসটাউন তার পরিপূর্ণতা পাওয়ার ঊষালগ্ন হতে অনেক মার্কিন নাগরিক অভিযোগ করতে শুরু করে জিম জোনস কাল্টের অনেকে তাদের শিশুদের চুরি করে জোনসটাউনে নিয়ে যাচ্ছে। এবং তার সাম্যবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত করছে। টনক নড়ে মার্কিন প্রশাসনে।
অভিযোগ তদন্তের লক্ষে মার্কিন সরকার তাদের এক কংগ্রেস সদস্যকে পাঠায় গায়ানায়। জিম জোনস গন্ধ পায় বিপদের এবং যোগাযোগ শুরু করে তার দীক্ষা গুরু সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। বন্ধুত্বের বার্তা পাঠায় উত্তর কোরিয়া, কিউবা, যুগোস্লাভিয়া সহ সমাজতান্ত্রিক অনেক দেশে। আগ্রহ প্রকাশ করে পিপলস টেম্পলকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন এক দ্বীপে স্থানান্তরের।
নাটকীয় ঘটনার জন্ম নেয় মার্কিন কংগ্রেস সদস্য লী রায়ানের জোনসটাউন ভ্রমণের সময়। টেম্পলের অনেক সদস্য জোনসটাউন ত্যাগের আগ্রহ প্রকাশ করে। ঘটনা জন্ম দেয় রক্তপাতের। গায়ানীজ বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে জোনসটাউন। টেম্পলের অনেকে দলছুট হয়ে পালাতে শুরু করে।
১৮ই নভেম্বর, ১৯৭৮ সাল। জিম জোনস তার কাল্ট সদস্যদের একত্রিত হওয়ার জন্যে আহবান জানায়। এই আবেদন ক্যাসেট রেকর্ডারের বাজিয়ে শোনানো হয়। জোনস তার অনুসারীদের বীরের মর্যাদায় পৃথিবী হতে বিদায়ের আহবান জানায়। আহবান জানায় গণ-আত্মহত্যার। ভেলিয়াম, ক্লোরাল হাইড্রেড ও সায়ানাইডের মত বিষ ইতিমধ্যে তৈয়ার ছিল। প্রথমে সামনে আনা হয় টেম্পলের শিশুদের। মা-বাবা তাদের সন্তানদের মুখে বিষ ইনজেক্ট করে খুন করে। তারপর নিজেরাও পাড়ি দেয় এ পথে। এবং এ লোমহর্ষক ঘটনার সমাপ্তি হয় জোনসের মৃত্যু দিয়ে। একে একে ৯১৮ জন আত্মহত্যা করে গায়ানার জঙ্গলে।
জিম জোনস ও জোনসটাউনের এ পৈশাচিকতা আত্মহত্যার ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানব সভ্যতা এ ধরণের ঘটনা দ্বিতীয়বারের মত সাক্ষী হবে কিনা সন্দেহ। হঠাৎ করে অতীতের এ ঘটনা মনে করার ২টা কারণ। প্রথমত: নভেম্বরেই ঘটেছিল এ নির্মমতা। দ্বিতীয়ত: মার্কিন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছর আগের এক বক্তব্য মনে হওয়ায়। ২০১৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণাকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গর্বভরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বন্দুক হাতে তিনি যদি নিউ ইয়র্ক শহরের ফিফথ এভিনিউতে গুলি করে মানুষ মারতে শুরু করেন তার সমর্থকদের কেউ তাকে ছেড়ে যাবেনা। কথাটা চার বছর পরও মিথ্যা মনে হবেনা। কারণ তার সমর্থকরা জিম জোনসের সমর্থকদেরই উত্তরসূরি। জোনসের দীক্ষা ছিল সমাজতন্ত্র, আর ডোনাল্ডের তন্ত্র হচ্ছে সাদা বর্ণবাদ।