মনে হচ্ছে আগামী চার বছরের জন্যে 'আমেরিকা ইজ ব্যাক' হতে যাচ্ছে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের মূল শ্লোগান। 'আমেরিকা ফার্ষ্ট' 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' বিদায়ী ট্রাম্প প্রশাসনের এসব শ্লোগানের কাউন্টার হিসাবে বাইডেন প্রশাসনের শ্লোগান কতটা এফেক্টিভ হবে সময়ই তা প্রমাণ করবে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা আমেরিকানদের চোখে অতীতের আমেরিকাকে অবমূল্যায়ন করে সাদা বর্ণবাদকে উস্কে দেয়ার ক্ষেত্রে 'Make America Great Again (MAGA) শ্লোগান স্ফূলিঙ্গের মত কাজ করেছিল। এবং স্ফূলিঙ্গ হতে সৃষ্ট দাবানল খুব সহসা যে নিভে যাবে তার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। 'ডিভাইড এন্ড রুল' ব্রিটিশদের এই কৌশলের সবকটা শাখা প্রশাখা ডোনাল্ড ট্রাম্প কাজে লাগিয়েছিলেন। গায়ের রঙের ভিত্তিতে আমেরিকাকে দুই শিবিরে বিভক্ত করা গেলে সাদা শিবিরকে বশকরা সহজ হবে, এমনটাই ছিল ট্রাম্পের ২০১৬ সালের নির্বাচনী কৌশল। এ কাজে তিনি দারুন সফল ছিলেন। যোগ্য অনেক প্রার্থীকে ডিঙ্গিয়ে দলীয় নমিনেশন করায়ত্ত করা ছিল তার প্রথম সাফল্য।
২০১৯ সালের সেন্সর অনুয়াযী আমেরিকার জনসংখ্যা ৩২ কোটি ২৮ লাখ। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৬.৩ ভাগ সাদা। সাদা সংখ্যাগুরুর দেশে একজন অর্ধ কালো, আফ্রিকান ইমিগ্রেন্টের সন্তান কি করে প্রেসিডেন্ট হতে পারে এমন একটা সমীকরণ মেলাতে পারলে আমেরিকার সমসাময়িক রাজনীতির কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে বারাক হোসেন ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক, দলীয় নমিনেশন পাবেন এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। আমিও ছিলাম তাদের একজন।
ওবামা নিজের ম্যাসেজের মাধ্যমে সাদা আমেরিকানদের একটা অংশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার অধিকাংশই ছিল বয়সে তরুণ ও সদ্য তালিকাভুক্ত ভোটার। দেশটার লাতিনো, বিশেষকরে কালো আমেরিকানদের জন্যে এ ছিল নিজদের অস্বিত্ব প্রমাণের বিশাল এক সুযোগ। আমেরিকান দাসপ্রথা বেশিদিন আগের ইতিহাস ছিলনা। গেল শতাব্দির মাঝামাঝি পর্যন্ত গায়ের রং'এর ভিত্তিতে বিভক্তি ছিল অফিসিয়াল। দাসপ্রথা বিলুপ্তি ও টিকিয়ে রাখার জন্যেই দেশটার শুরু হয়েছিল সিভিল ওয়্যার। আমেরিকার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি দাস প্রথার বিলুপ্তি। এমনকি গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়েও তারা টিকিয়ে রেখেছিল দাসপ্রথার চিহ্ন। দক্ষিণের এসব অঙ্গরাজ্যগুলোই আজকের রিপাব্লিকান তথা ট্রাম্প শিবিরের ভোট ব্যাংক।
দিন দিন বদলে যাচ্ছে আমেরিকার ডেমোগ্রাফি। এক কালের সাদাদের স্বর্গ দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোতে দলে দলে ভিন্ন রংয়ের মানুষ মাইগ্রেট করছে। যার অন্যতম লাতিনো ও এশিয়ান জনগুষ্টি। নতুন প্রজন্মের সাদা আমেরিকানদের অনেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে তাদের এনচেষ্টারদের পুরানো বিশ্বাস হতে। এবং তাতে লাভবান হচ্ছে ডেমোক্রেটরা। ডেমোক্রেটদের মূল ভিত্তি হচ্ছে উপকূলীয় অঙ্গরাজ্য গুলো। যেখানে বছরের পর বছর ধরে ইমিগ্রাণ্টরা বাসা বাধছে। বংশ বিস্তার করছে জ্যামতিক হারে। নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া তার অন্যতম।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আমার মত প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রাণ্টদের প্রায় সবাই ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়েছিল নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্যে। কালো আমেরিকানদের জন্যে ভোট দেয়া ছিল ধর্মীয় দায়িত্বের মত। সাথে যোগ দিয়েছিল লাতিনোরা। ওবামা এমনিতেই হেরে যাবে, এমন হিসাব কষে সাদা আমেরিকানদের একটা বিশাল অংশ ভোটে অংশ নেয়নি। ঘরে বসে উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার স্বপ্ন তাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় নির্বাচনের রাতে। ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসেলভ্যানিয়া, ওয়াইও'র মত সুইং ষ্ট্যাট গুলো জেতা ছাড়াও জিতেছিল গভীর রিপাব্লিকান মিজৌরি অঙ্গরাজ্য। সাদা আমেরিকানদের জন্য এ ছিল বিশাল এক চপোটাঘাত এবং ঘুম ভাঙ্গানোর ম্যাসেজ।
২০১৬ সালে এসে সাদা বর্ণবাদী ম্যাসেজ পরিপূর্ণতা পায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ম্যাসেজে। তিনি লুকানোর চেষ্টা করেননি সাদা আধিপত্য। আগের দুই নির্বাচনে অনেকটা একঘরে হয়ে যাওয়া প্রাপ্ত বয়স্ক সাদা আমেরিকানরা গৃহযুদ্ধের পর এই প্রথম ট্রাম্পের চেহারায় নিজেদের নেতা আবিস্কার করতে সক্ষম হয়। এ ছিল অনেকটা গেল সহস্রাব্দির প্রথম দিকে জার্মানিতে এডলফ হিটলারের উত্থাণের মত।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী হিলারী ক্লিনটনের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, জেন্ডার ফ্যাক্টর ও কর্পোরেট আমেরিকার সাথে নিবিড় সম্পর্ক। স্বামী বিল ক্লিনটনের প্রেসিডেন্টশিয়াল লাইব্রেরির জন্যে হিলারী ক্লিনটন এমন কোন দেশে যাননি যেখানে গিয়ে কনট্রিবিউশন আনার চেষ্টা করেননি। স্বামী-স্ত্রী মিলে বিভিন্ন খাত হতে পারিবারিক আয় বাড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। যার অন্যতম ছিল কর্পোরেট আমেরিকা। এসবের কারণে আফ্রিকান আমেরিকানরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে হিলারীর প্রতি। তাতে যোগ দেয় লাতিনোদের একটা বিরাট অংশ। ডেমোক্রেটদের যুব ভোটারদের প্রায় সবাই বামঘেষা বার্ণি সান্ডার্সের সমর্থক হওয়ায় ভোট প্রসেস হতে নিজেদের নিস্ক্রিয় করে ফেলে। অন্যদিকে সাদা আমেরিকানরা যারা আধা কালো ওবামাকে প্রেসিডেন্টকে মেনে নিতে পারেনি, তারা সংঘবদ্ধ হয় ট্রাম্পের ছায়াতলে। ভোটের ফলাফল, ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত জয়। আসলে এ জয় অপ্রতাশিত ছিলনা। এ ছিল অনেক ফ্যাক্টরের সন্মিলিত যোগফল।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা শিক্ষা পেয়েছিল। এবং এ শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল, ভোটে জিততে চাইলে ব্যালট পেপার হাতে নিয়ে ভোট দিতে হবে। গেল চার বছর ট্রাম্পের বর্ণবাদী উস্কানী এক অর্থে কালোদের মোবিলাইজ করতে অবদান রেখেছিল। ডেমোক্রেট দলীয় নেতারা এমনটা একটা ম্যাসেজ রুট লেভেলে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবারের ভোট হবে বাকি আমেরিকানদের জন্যে অস্বিত্বের লড়াই। এবং এ ম্যাসেজ আমার মত কোটি কোটি আমেরিকান ভোটার গিলেছিল। যার একটা বিরাট অংশ ২০১৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলাফল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প কথিত ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে নিজের পরাজয়কে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছেন। আসলে এসব জালিয়াতির অভিযোগের পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য একটা ম্যাসেজ, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার শিষ্যদের কাছে কালো বা অন্য রংয়ের ভোটারদের ভোট দেয়াটাই জালিয়াতি। তাদের অনেক এখন পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকদের সমান ভোটাধিকার।
উজ্জীবিত হওয়ার মত প্রার্থী নন জোসেফ বাইডেন। তিনি ট্রেডিশনাল আমেরিকান। সামনে যা করবেন তা অতীত আমেরিকারই প্রতিফলন হবে। তবে সব বিচারে তা হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশকে ভাগ করার ভয়াবহ পরিকল্পনা হতে হাজার গুন ভাল। ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনকে নির্বাচিত করার জন্যেই মানুষ ভোট দেয়নি, মূল উদ্দেশ্য ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একটা বিষাক্ত সাপকে ক্ষমতা হতে সরানো।
(আমি রাজনৈতিক পন্ডিত নই। যা লিখছি তা একজন সাধারণ আমেরিকান ভোটার হিসাবে লিখছি। তথ্য উপাত্তে অনেক ত্রুটি থাকতে পারে, যার জন্যে আগ বাড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি