চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া এক খুনের ঘটনা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষের মৃত্যু এতটা কষ্টের হয় ভাবতেও কষ্ট লাগছিল। যদিও মন খারাপ করার মত ব্যক্তিগত কোন কারণ ছিলনা ঘটনায়। এমন ঘটনা এখন বাংলাদেশে হরহামেশা ঘটছে। মিডিয়ায় আসছে কিছু কিছু, অধিকাংশই হয়ত সামাজিক কারণে ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে।
মাধব দেবনাথ পেশায় স্বর্নকার। চট্টগ্রামে এক দোকানে কাজ করতো। পিন্টু দেবনাথ তার আত্মীয়। বিথী দেবনাথ পিন্টূর স্ত্রী। পাশাপাশি থাকার কারণে মাধব মাসে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে পিন্টূর বাসায় তিন বেলা খায়। সব চলছিল বাংলাদেশের যে কোন নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিবারের জীবনের ছকে। গোল বাধে কিছুদিনের জন্যে মাধবের অসূখ। পিন্টূর স্ত্রী তার দেখভাল করার দায়িত্ব নেয়। এখানেই জন্ম মূল ঘটনার। বিথী ও মাধব জড়িয়ে যায় পরকীয়া সম্পর্কে। এ সম্পর্ক দ্রুত মোড় নেয় শারীরিক সম্পর্কে। বাংলাদেশের আধুনা প্রেম অথবা পরকীয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় মাধব তার মোবাইল ফোনে ধারন করে শারীরিক সম্পর্কের জীবন্ত ছবি। আর দশটা সম্পর্কের মতই এ সম্পর্কও একসময় তেতো হয়ে আসে, বিশেষকরে গৃহবধূ বিথীর জন্যে। স্বামী সংসারের কথা ভেবে অস্বীকার করে শারীরিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে। রেগে যায় মাধব। এবং প্রতিশোধের অংশ হিসাবে ধারনকৃত ভিডিও পাঠিয়ে দেয় বিথীর স্বামী ও শ্বাশুড়ির কাছে। বিথী দেবনাথ সিদ্বান্ত নেয় আত্মহত্যার। কিন্তু বিচক্ষণ বিথী সিদ্বান্ত নেয় তার মৃত্যুর জন্যে যে দায়ী তাকে আগে এ পৃথবী হতে বিদায় করার। এখানেই জন্ম নেয় ঘটনার দ্বিতীয় অধ্যায়।
ডিসেম্বরের ২ তারিখ রাত দশটার দিকে এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। বিথীর শ্বশুরবাড়ির বাকি সবাই ঘরের বাইরে চলে যায়। সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে মাধব। বিথীও সুযোগটা কাজে লাগায়। মাধবকে প্রস্তাব দেয় ভিন্ন আঙ্গিকের শারীরিক মিলন। মাধব লুফে নেয় সে প্রস্তাব। মিলনের অংশ হিসাবে প্রথমে মুখ সহ দু'পা দু'হাত বেধে ফেলে মাধবের। তারপর তার শরীরের উপর চড়ে বসে গামছা দিয়ে ফাঁস লাগায় গলায়। মাধব দেবনাথের জীবন এভাবেই সমাপ্ত হয়।
গতমাসে আরও এক চমকপ্রদ প্রেমের কাহিনী মিডিয়ায় এসেছে। নবম শ্রেনী পাশ এক ছেলে মোবাইলে মেয়ে মানুষ সেজে পরিচয় করতো অন্য মেয়েদের সাথে। তারপর ওসব মেয়েদের রেফারেন্স দিতো যোগ্য এক ছেলের। এবং ঐ ছেলে ছিল সে নিজে। মেয়েরা তাকে ফোন করতো। দেখা করতো এবং সম্পর্ক এক সময় শরীর পর্যন্ত গড়াতো। এবং এখানেও এক পক্ষ মোবাইলে ধারণ করতো শারীরিক সম্পর্কের লাইভ ভিডিও। এক পর্যায়ে ছেলে তার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নামতো। মেয়েদের ব্ল্যাক-মেইল করে অর্থ আদায়ের পাশাপাশি চালিয়ে যেত শারীরিক সম্পর্ক। এ তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রী শুরু করে কলেজের শিক্ষিকা পর্যন্ত ছিল। তালিকার একজন বেঁকে বসলে পুলিশের ফাঁদে ধরা পরে প্রতারক।
পরকীয়া! শব্দটা ভার্চুয়াল দুনিয়ার মতই জনপ্রিয় উঠছে দিন দিন। ধীরে ধীরে এ বাস্তবতা বাংলাদেশের বিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে বাসা বাধছে দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবার সহ সমাজের সর্বস্তরে। পরিবার রেখে যারা প্রবাসে বাস করছেন তাদের সংসারে এর আগ্রাসন এখন করোনা ভাইরাসের চাইতেও ভয়াবহ। অথচ সমস্যাটা নিয়ে কথা বলতে আমরা কেউ আগ্রহী নই।
মানব মানবীর সম্পর্ক চীরন্তন। রাষ্ট্রীয় আইন অথবা সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে এসব সম্পর্ক আটকে রাখা যায়না। মানব সভ্যতা যতদিন বেঁচে থাকবে প্রেম ভালবাসার সম্পর্কও ততদিন লতায় পাতায় প্রসারিত হবে। আমাদের ট্রাডিশনাল ধ্যাণ ধারণায় এসব সম্পর্কের শুরু ও শেষের একটা সীমানা আছে। এ সীমানায় যা ঘটবে তা একটা প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবোধক হলেও দিনশেষে সবাই তা মেনে নেয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়ে মনুষ্য জীবনের নতুন এক অধ্যায়।
জগত সংসারের চার দেয়ালে একজন রক্ত-মাংসের মানুষকে আমরা নির্বাসিত করতে অভ্যস্ত হয়ে পরি। নির্বাসনের বৈধ একটা নাম দিয়ে ইতি টানার চেষ্টাকরি একজন পুরুষ অথবা মহিলার আপন স্বত্তার। সমস্যা দেখা দেয় অন্য জায়গায়। মানুষ বেড়ে উঠে। বয়স বাড়ে। কিন্তু ভেতরের স্বত্তাটা একই গতিতে বেড়ে উঠেনা। শরীরের মত মুটিয়ে গিয়ে বুড়ো হয়না। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা তাকে খাঁচায় আটকে ফেলে। এক সময় মানুষ মুক্তি চায় তার দমবন্ধ হওয়া বন্ধন হতে। এখানেই বপিত হয় সম্পর্কের নতুন বীজ। যার সামাজিক স্বীকৃতি, পরকীয়া হিসাবে। আধুনা এ বাস্তবতা আসলেই কি পরকীয়া, না মানব সম্পর্কের ন্যাচারাল এভ্যালুয়শন!
একটা সমাজে সংস্কৃতির গতি প্রকৃতি নির্ণয় করে তার অর্থনৈতিক সূচকগুলো, কথাটা আমার নয়, সমাজ বিজ্ঞানীদের। আমাদের সমাজেও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসছে। তার প্রভাব গড়াছে আমাদের সংস্কৃতিতে। পরিবর্তন হচ্ছে মানব মানবীর সম্পর্কের সংজ্ঞায়। একশ বছর আগে বিয়ে, সংসার মানেই ছিল রক্ত মাংসের একজন নারীকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করে সামাজিক পরাধীনতায় আটকে রাখা। আজকের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তা আর সম্ভব হচ্ছেনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংসার সংজ্ঞায় নারীকে আগের মত আটকে রাখা যাচ্ছেনা বেধে দেয়া পরিসরে। একটা সময় পার হতেই হালকা হয়ে যাচ্ছে নর-নারীর মনোজগতের বন্ধন। শারীরিক সম্পর্ক ঠাঁই নিচ্ছে ইতিহাসে। ফাটল দেখা দিচ্ছে পারিবারিক অবকাঠামোতে। এসব কারণই মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে নতুন সম্পর্কের সন্ধানে। এ সন্ধান কেবল পুরুষদের বেলায় সীমাবদ্ধ থাকছেনা, ছড়িয়ে পরছে বিথী দেবনাথদের মত সংসারের চার দেয়ালে আটকে থাকা মেয়েদের মনেও।
সামাজিক ও ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে পরকীয়া সম্পর্ককেও অপরাধের পর্যায়ে নামিয়ে আনা খুব সহজ কাজ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাতে এ সম্পর্কের যেসব সমস্যা তার দিকে মোটেও চোখ ফেরানো হচ্ছেনা। বস্তবতা হচ্ছে, পরকীয়া থাকার জন্যে এসেছে, নিকট ভবিষতে কোন এক মন্ত্রবলে বিথী ও মাধব দেবনাথদের এ বিপজনক বাঁক হতে সরানো যাবে তার কোন সম্ভাবনা নেই। এখনই আমাদের ভেবে দেখতে হবে কেন বিথী দেবনাথদের মত রক্ষণশীল মেয়েরা সম্পর্কের উষালগ্নে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। গবেষণা করে দেখতে হবে কোন বাস্তবতায় একজন নারী তার গোপন সম্পর্কের সদ্য চেনা পুরুষকে তাদের শারীরিক মিলনের জীবন্ত ছবি ধারণ করতে দেয়। এসব জানা থাকলে নিশ্চয় বিথী দেবনাথ খুনের মত ভয়ংকর পথে পা বাড়াতেন না।