বিজয় দিবসের শুভেচ্ছায় ভাসছে দেশ। বিশেষকরে সোশ্যাল মিডিয়াতে এর জোয়ার একটু বেশী। বিভিন্ন বিশেষণে আমরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি স্বাধীনতার সূর্যসেনাদের। পৃথিবীর দেশে দেশে সব কালে এমনটাই হয়। যারা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধে যায় তাদের সন্মান ও শ্রদ্ধা ভরে জাতি স্মরণ করে এবং কৃতজ্ঞতা জানায়।
আমাদের বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ একটু ব্যতিক্রমধর্মী বিভিন্ন কারণে। এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধা দুটোর পরিচয়ই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। এবং যে দল যখন ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও হয় তাদের তৈরি স্ক্রিপ্ট। যোদ্ধাদের সংখ্যা ও তালিকা বানানো হয় রাজনৈতিক ডিমান্ড হতে।
বর্তমান সরকারের আমলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার অন্যতম ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে গায়ে মুক্তিযোদ্ধার ছাপ। ক্ষমতার বাকি সব ইন্সটিটিউটের মত জনপ্রতিনিধি হওয়াও মানে সরকারী সম্পদ লুণ্ঠনের অবাধ স্বাধীনতা। এমন স্বাধীনতা একজনকে তার পরবর্তী ৬/৭ প্রজন্মের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করে দেয়। সংগত কারণেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড় এখানে প্রতিযোগিতামূলক। এসব অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাই একজনকে বাধ্যকরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজাতে। সংগত কারণেই বাংলাদেশে এ মুহূর্তে বৈধের চাইতে অবৈধ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাই বেশী।
দুঃখটা অন্য জায়গায়! বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এত বীর মুক্তিযোদ্ধা অথচ স্তুতি বন্দনার আসরে দাঁড় করিয়ে দিলে একজন যোদ্ধাও ফ্রন্টের কাহিনী সামনে আনতে পারেনা। বলতে শোনা যায়না কবে, কোথায় ও কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে বীর উপাধি পেয়েছে। কাহিনীর বদলে এসব বীরের দল উপস্থাপন করে এক ব্যক্তির স্তুতি, এক পরিবারের প্রতি রাজনৈতিক পদ ইস্যু করার কৃতজ্ঞতা।
আমরা মহাসমারোহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রোমন্থন করি, অথচ সেখানে থাকেনা জেনারেল ওসমানী অথবা কোন সেক্টর কমান্ডারের নাম। আমাদের শোনানো হয় সেক্টর কমান্ডারদের কেউ কেউ নাকি শত্রু পক্ষের এজেন্ট হয়ে যুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী, অথচ তারা থাকে অপাংক্তেয়। মুক্তিযুদ্ধ মানেই আমাদের গেলানো হয় এক ব্যক্তি ও এক পরিবারের অবদান। ভাবটা এমন, ওরা একাই ৯০ হাজার পাকিস্তানী সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল।
আমি আমার এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার অনেকের কথা বলতে পারি যারা যুদ্ধের প্রথম প্রহরে ব্যাংক ডাকাতি সহ এমন অনেক কাজ করেছিলেন যার সাথে যুদ্ধের কোন সম্পর্ক ছিলনা। লম্বা সময় নিখোঁজ থাকার পর ১৬ই ডিসেম্বরে দেশে ফিরে নাম লিখিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়। পরবর্তীতে হাতিয়ে নিয়েছিলেন রাজনৈতিক পদ ও নিশ্চিত করেছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের চাবি।
রাজনৈতিক নেশা হতে বেরিয়ে আসুন কিছুটা সময়ের জন্যে আমরা দম ফেলি। ফিরে যাই ৭১'সালে। হাতরে দেখি কি ঘটেছিল ঐ সময়টায়। কেবল রাজনৈতিক ধান্ধায় অসত্য বলার যে অভ্যাস আমরা করছি তার সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে একটু ভাবি।