(আর্কাইভ হতে নেয়া)
সব গল্পের শেষটাই যে সত্যের জয় আর অসত্যের পরাজয় দিয়ে শেষ হতে হবে তা নয়। জীবনের অনেক গল্পই রূপালী পর্দার কাহিনীর মত হয়না। এর শুরু অথবা শেষ নদীর গন্তব্যের মত সাগরে গিয়ে শেষ হয়না। এখানে কাহিনীর পীঠে অনেক কাহিনী থাকে। এর ঘটনা প্রবাহ ঘাটে ঘাটে হোঁচট খায়। মুখ থুবড়ে পরে। এসব আমাদের ঘরের গল্প। গড়পরতা এসব নিয়ে কেউ লিখতে অথবা পড়তে বলতে গেলে বিরক্তি চলে আসে। যে কাহিনী প্রতিদিন আমাদের ঘরে ঘটছে তার উপর গল্প উপন্যাস কারও ভাল লাগার কথা নয়। বিশেষকরে এ শেষটায় যদি মিলনের স্বাদ না থাকে।
মার্জিয়া কান্তাকে আমি দেখিনি। তাকে নিয়ে কিছু একটা লিখবো তারও কোন কারণ ছিলনা। কারণ কান্তারা আমাদের জীবনেরই অংশ।
প্রাসংগিক চরিত্র। তারা না থাকলে জীবন হয়ত সম্পূর্ন হতোনা। তার বাড়িও আমার বাড়ি হতে বেশিদূরে না। লোকাল বাসে চড়লে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের পথ। বেলাবো উপজেলায় বীরভাগবেড় নামে কোন গ্রাম আছে আমার জানা ছিলনা। জন্মভূমির মাটির সাথে সম্পর্ক নেই আজ অনেক বছর। গেল সহস্রাব্দির শেষদিকে রাজশাহীর বরেন্দ্রে এলাকার পত্নীতলা, বদলগাছি, ধামইরহাটের গ্রাম-গঞ্জ গুলোই ছিল শেষবারের মত কাছ হতে দেখা বাংলাদেশ। মা আর মাটির টান আলগা হয়ে গেলেও আলগা হয়নি অনেক স্মৃতি। পত্নীতলার দিনগুলো ছিল তেমনি কিছু স্মৃতি।
বাংলাদেশের প্রতি গ্রামেই কান্তাদের দেখা মেলে। ওরা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মনিয়ে স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার। আশায় বুক বেধে কোন এক সুন্দর সকালে বেরিয়ে পরে নতুন জীবনের সন্ধানে। কান্তাও তাই করেছিল। বেলাবো হতে ঢাকাগামী বাসে চেপে রওয়ানা দিয়েছিল। ওখান হতে সাভারের আশুলিয়া। পোশাককর্মীদের টার্গেট করেই হয়ত প্রতিষ্ঠা করেছিল 'কান্তা বিউটি পার্লার'। অজগ্রাম হতে উঠে আসা একজন উদ্যোক্তার ভাগ্যপ্রবাহ কতটা জটিল হতে পারে তা নিয়ে বলার কিছু থাকেনা। কারণ এসব আমাদের ঘরের কাহিনী। একজন সদ্য যৌবনা তরুনী উদ্যোক্তার কাহিনী সমসায়কি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা জটিল হতে পারে তার বর্ণনা না দিলেও চলবে।
আশুলিয়ায় পরিচয় হয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারি এলাকার শহিদুল ইসলামের সাথে। পরিচয় পর্ব শেষহয় বিয়ের পিড়িতে। জীবন হয়ত আর দশটা জীবনের মতই ঘাত-প্রতিঘাতে বয়ে যাচ্ছিল। স্বামী,সংসার আর ব্যবসা নিয়ে কান্তা স্বপ্ন দেখছিলো আরও বড় কোন স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্নে বৈরী বাতাস লাগতে সময় লাগেনি।
শহিদুল ইসলাম আর আগেও একাধিক বিয়ে করেছিল। আগের কোন স্ত্রীকে বঞ্চিত না করে হিসাব কষেই কান্তাকে বিয়ে করেছিল। উদ্দেশ্য তার ব্যবসা হাতিয়ে নেয়া। ধর্মের কল কারও জন্যে অপেক্ষায় থাকেনা। শহিদুলের জন্যেও না। সময় গড়ানোর সাথে সব পানির মত পরিস্কার হয়ে যায় কান্তার কাছে। শুরু হয় সম্পর্কের নতুন অধ্যায়।
কাহিনী হয়ত অনেকদূর গড়িয়েছিল। তার সবটার সাথে আমরা পরিচিত নই। কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, মান-আভিমান, হয়ত সবই ছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কান্তাকে দেখা যায় নিজ গ্রামে। ওখানে হাজির হয় স্বামী শহিদুল। একজন প্রফেশনাল বাটপারের মত দুর্বলমনের কান্তাকে বশকরে ভারত ভ্রমণের লোভ দেখিয়ে।
প্রথমে গন্তব্য নিজেদের আশুলিয়ার বাড়ি। ওখান হতে প্রথমে নদীর ভাঙ্গন দেখানো কথা বলে নিয়ে যায় শরীয়তপুরে। খুন করার প্রথম চেষ্টা ভেস্তে যায় ওখানে। পরবর্তী গন্তব্য পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। ওখানে সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত দেখার লোভ উপেক্ষা করতে পারেনা কান্তা।
কুয়াকাটার আল মদিনা হোটেলেই ঘটে আসল ঘটনা। গলা টিপে কান্তার ফুস্ফুস হতে শেষ শ্বাসটা বের করে নেয় শহিদুল। সহযোগী হিসাবে ছিল বন্ধু মামুন। খাটের তলায় লাশ লুকিয়ে দুই বন্ধু পালিয়ে যায়। লাশের তথ্য যখন হোটেল কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। পুলিশি ঝামেলা এড়ানোর জন্যে হোটেলের সবাই মিলে লাশ ফেলে দেয় সমুদ্রে। বিশাল এক ঢেউ এসে বুকে তুলে নেয় লাশ। মহাকালের বাস্তবতা হতে মুছে যায় কান্তা নামের কারও অস্তিত্ব।
যারা গল্পের শেষটায় সত্যের জয়ে চোখের পানি ফেলতে আভ্যস্ত তাদের জন্যে সুখবর হচ্ছে কান্তা হত্যার সবাই এখন পুলিশি হেফাজতে। এমনকি আল মদিনা হোটেলে যারা লাশ সরিয়েছিল তারাও।
আমার কাহিনীর এখানেই শেষ হতে পারতো। এতদিনে বঙ্গোপসাগরের কোন এক বাঁকে কান্তার শরীর হতে মাংস খুবলে খেয়ে হাঙ্গরের দল ফিরে নিশ্চয় ফিরে গেছে নতুন শিকারের সন্ধানে। অন্যদিকে সাগরপাড়ে যারা ধরা পরেছে তাদের ঘিরেও তৈরী হচ্ছে নতুন কোন গল্প। এ গল্প নিয়েও তৈরী হতে পারে নতুন কোন সিনেমা। যে সিনেমার প্রধান চরিত্র হবে প্রদীপ কুমার দাসের মত কোন ওসি। লিয়াকতের মত কোন বরকান্দাজ। ওখানকার এসপির মত একজন এসপি। নিশ্চয় সবাই মিলে কান্তার লাশের দরদাম করবে। একসময় ফয়সালা হবে। উর্দিওয়ালাদের পকেট চাহিদা মিটিয়ে শহিদুল চক্র বেরিয়ে আসবে জেল হতে। সন্ধানে নামবে নতুন কোন কান্তার।