আমেরিকার শাসন ব্যবস্থার উপর যাদের বেসিক নলেজ নেই আমার এ লেখাটা পড়া হবে তাদের জন্যে সময়ের অপচয়। লেখাটা তাদের জন্যেও নয় যারা কোভিড ভাইরাসে আমেরিকানদের মৃত্যু সংক্রান্ত আমার এক লেখায় মন্তব্য করেছেন, 'আমেরিকান যত বেশি মরবে মুসলমানদের জন্যে তা ততই শুভ সংবাদ'।
মার্কিন ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল ডেড বডির উপর দেশটার লেজিস্লেটিভ ব্রাঞ্চ আজ শেষ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাকে বিদায় জানিয়েছে। সমাপ্ত হয়েছে প্রেসিডেন্টের ২য় ইম্পিচমেন্ট ট্রায়াল। রায়: নট গিলটি!
অপ্রত্যাশিত ছিলনা কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেটের এ রায়। কংগ্রেসের নিম্ন-কক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ একক ক্ষমতা রাখে দেশটার সিটিং প্রেসিডেন্টকে ইম্পিচ করার। তার জন্যে ঐ চেম্বারের সিম্পল মেজোরিটি ভোটই যথেষ্ট। ওখানে ডেমোক্রেটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইম্পিচমেন্ট ভোটে ট্রাম্পের দল রিপাব্লিকানদলীয় ১০ জন সদস্যও যোগ দিয়েছিল ডেমোক্রেটদের সাথে। হাউস ইম্পিচ করার পর তা যায় সিনেটে। এবং ওখানে শুরু হয় ট্রায়াল। ট্রায়াল প্রসেসে সিনেটের ১০০ জন সদস্যের ভূমিকা হয় জুরির। হাউস সদস্যদের কজন আবির্ভূত হন প্রসিকিউটর হিসাবে। আসামী পক্ষ পাঠায় তাদের উকিল। দুই পক্ষ তুলে ধরেন তাদের কেইস। এবং শুনানি শেষে সিনেট সদস্যরা ভোট দেন। এ ভোটই গৃহীত হয় ট্রায়ালের রায় হিসাবে।
এ যাত্রায় ৫৭-৪৩ ভোটে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্থ করা হয়েছে। শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে অফিস হতে বিদায় করতে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। ১০০ সদস্যের সিনেটে ডেমোক্রেট রিপাব্লিকানদের আসন সংখ্যা এখন ৫০-৫০। স্বাভবতই ট্রায়ালের শুরুতেই বুঝা গিয়েছিল আগের বারের মত এ যাত্রায়ও ডোনাল্ড ট্রাম্প পার পেয়ে যাচ্ছেন। আসুন, দেখা যাক দ্বিতীয় বারের মত কেন এমনটা হয়েছে। কেন দলীয় ভোটারদের মাঝে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা এখনো শতকরা ৮০ ভাগের উপর।
অনেকে অনেকভাবে বিচার করলেও আমার বিচারে রিপাব্লিকান পার্টির মূল খুঁটি হচ্ছে সাদা বর্ণবাদ। অর্ধ শিক্ষিত সাদা আমেরিকান পুরুষদের সিংহভাগই রিপাব্লিকান। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে কনফেডারেসি ভক্ত আমেরিকানরা। আমেরিকান সিভিল ওয়ারের মূল ভিত্তি ছিল দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখা অথবা বিলোপ করা। কালো আমেরিকানদের স্থায়ীভাবে দাস বানিয়ে নিজেদের কাজে ব্যবহার করার দাবিই ছিল কনফেডারেটদের আসল দাবী। তারা আমেরিকান ইউনিয়নের বাইরে গিয়ে নতুন এক রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল। গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ছিল দাসপ্রথার সূতিকাগারে।
গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল কনফেডারেটরা। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, কনফেডারেসির আসল ঘটি ছিল আমেরিকার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলো। সমসাময়িক ভোট-যুদ্ধে রিপাব্লিকান দলীয় ভোট-ব্যাংক হিসাবে বিবেচিত হয় এসব অঙ্গরাজ্যগুলোই।
আজকের ভোটে ডোনাল্ড ট্রাম্প শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়েছেন কারণ সিনেটের রিপাব্লিকান দলীয় ৪৩ জন সদস্য তাকে নির্দোষ ঘোষণার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ট্রাম্প ক্ষমতা হতে বিদায় নিয়েছেন, প্রশ্ন উঠতে পারে এত অপকর্মের পরেও কেন আমেরিকান রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এত প্রভাব। কেনই বা কংগ্রেস সদস্যরা তার পক্ষ নেয়! এসবের একটাই উত্তর; রুট লেভেলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা। সিনেট অথবা হাউসে যারাই ট্রাম্পের বিপক্ষে যাবে তারাই নিজ এলাকায় ভোটারদের রোষের সন্মুখিন হবে। এবং এভেঞ্চুয়েলি, প্রাইমারী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন হারাবেন।
ট্রাম্প সমর্থকদের অনেকে আশায় আছেন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে তিনি ফিরে আসবেন এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতবেন। এমন আশার কোন ভিত্তি আছে বলে মনে হয়না। একটা বাস্তবতা আমাদের মাথায় রাখতে হবে; যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিপাব্লিকান অথবা ডেমোক্রেট দলীয় ভোটারদের একক ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন না। তার জন্যে যাই নির্দলীয় ভোটারদের ভোট। দেশটার ৩০% ভোটার রিপাব্লিকান দলীয়। কেবল ৩০% ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখা আমেরিকায় সম্ভব হয়না। এই ৩০ ভাগ ভোটার রিগার্ডলেস অব ক্যান্ডিডেট ভোট দেবে নিজ দলীয় প্রার্থীকেই।
আমেরিকান অঙ্গরাজ্যগুলো দুই শিবিরে বিভক্ত; এক শিবিরের পরিচয়, নীল। এবং নীল অঙ্গরাজ্যগুলোতে ডেমোক্রেটদের প্রাধান্য। এসব অঙ্গরাজ্যে রিপাব্লিকান দলীয় প্রেসিডেন্টশয়াল প্রার্থীর বিজয় একেবারেই অসম্ভব। অন্য শিবিরের পরিচয়, লাল। লাল শিবিরে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থীর বিজয়ও প্রশ্নাতীত। নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারিত হয় বেশকটা সুইং অঙ্গরাজ্যের ভোটে। এ তালিকায় আছে, ফ্লোরিডা, পেন্সেলভ্যানিয়া, মিশিগান, উইসকন্সিন ও নর্থ ক্যারোলাইনা। ইদানীং এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে এক কালের ব্রান্ডেড লাল অঙ্গরাজ্য জর্জিয়া ও এরিজোনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের জনপ্রিয়তা আরও উঁচুতে নিয়ে যাতে পারবেন সন্দেহ নেই, তবে তা হবে কেবল লাল অঙ্গরাজ্যগুলোতে। নির্দলীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটাররা বিশেষ কোন দলের বিশেষ কোন ব্যক্তির চেহারা দেখে ভোট দেয়না। তারা ভোট দেয় ইস্যুর উপর। ট্রাম্প সমর্থকদের জন্যে দুঃসংবাদ হচ্ছে, এসব সুইং অঙ্গরাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা এখন তলানিতে। তাই ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে রিপাব্লিকান দলীয় প্রার্থী হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওসব অঙ্গরাজ্যে গো-হারার সম্ভাবনাই বেশী।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন স্বাভাবিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তিনি ছিলেন হোয়াইট সুপ্রেমেসির প্রতিনিধি। প্রাউড বয়, কেকেকে'র মত হিংস্র বর্ণবাদী গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। বর্ণবাদ সমস্যা আমেরিকার পুরানো সমস্যা। ট্রাম্পের বিদায়ের সাথে এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে আমেরিকানরা এখন অনেক পরিপক্ক ও সচেতন। একদল উন্মাদ বর্ণবাদই আমেরিকার পরিচয় নয়, তাই বিশ্বাস করার কারণ নেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একজন তৃতীয় শ্রেণীর ব্যবসায়ী দ্বিতীয়বারের মত হোয়াইট হাউসে বসতে সক্ষম হবেন।