বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। আগ্রহ থাকার কোন কারণও নেই। হোক তা জাতীয় অথবা স্থানীয় পর্যায়ে। কারণ দেশটার নির্বাচনী প্রক্রিয়া এখন কেবল প্রশ্নবিদ্ধই নয়, বরং পা হতে মাথা পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারড্। নির্বাচন মানে ক্ষমতাসীন দলের পেশী শক্তি প্রদর্শনের র্নিলজ্জ মহড়া। এসব আগেও ছিল, তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিবেশী দেশের প্রতক্ষ্য মদদে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর নির্বাচন নামের এককালের জাতীয় উৎসবকে লাশে পরিণত করেছে।
নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছে। ২৪০০ ভোট বেশি পেয়ে ক্ষমতাসীন দলীয় প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। দেশটার সমসাময়িক নির্বাচনী প্রেক্ষাপটের তুলনায় এ ফলাফল ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর। এ পৌরসভার ভোটার সংখ্যা নিশ্চয় কয়েক লাখ। নরসিংদী আর দশটা পৌরসভার মত ঘণবসতিপূর্ণ একটা এলাকা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারে এ শহর বাংলাদেশের অনেক শহরের চাইতে ব্যপকভাবে এগিয়ে। তাই ২৪০০ ভোটের ব্যবধানটা একটু অবাক করেছে। লাখ লাখ ভোটারের ম্যন্ডেটে মাত্র ২৪০০ ভোটের তফাৎ যাচাই বাছাই করলে নিশ্চয় ধারণা জাগবে ভোট প্রক্রিয়া নিশ্চয় অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল?
গেল কয়েক বছরে সোস্যাল মিডিয়ার কারণে প্রবাসে যে ধারণা পেয়েছি তাতে মনে হয়ে হয়েছে এক কালের অবহেলিত, নোংরা ও ক্রাইম সিন্ডিকেটের লীলাভূমি নরসংদীতে উন্নতির সুনামি বয়ে গেছে। উন্নতির ফেরিওয়ালা, মানবতার ধারক বাহক জনৈক মেয়রের হাত ধরে শহর বদলে গেছে। বাস্তবেই বদলে গেছে অনেক কিছু। ২০১৭ সালে দেখা প্রসারিত রাস্তা-ঘাট, সুউচ্চ অট্টালিকা, মোড়ে মোড়ে ব্যানার সম্বলিত মূর্তি তার দিকেই আঙ্গুল দেখিয়েছিল। কিন্তু আমরা যারা কসমেটিক উন্নতির চমককে অর্থনৈতিক মানদন্ডে উন্নতি আখ্যা দিতে অভ্যস্ত নই, তাদের কাছে চকচকে রাস্তাঘাট আর উচ্চ অট্টালিকাকে উন্নতির মাপকাঠি ধরা হয়না । বরং ভেতরের চিত্রকে ধামাচাপা দেয়ার কৌশল মাত্র। নরসিংদীতে তাই ঘটেছে কিনা জানা নেই।
খটকার শুরুটা যখন ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে সোস্যাল মিডিয়ায় বহুল প্রশংসিত ও প্রচারিত বর্তমান মেয়ককে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। গুরুতর কিছু না ঘটলে এমনটা করার কোন কারণ ছিলনা। ভেতরের খবর হয়ত এখন বাইরে আসবেনা, কিন্তু সময় হলে হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের মত জনসন্মুখে বেরিয়ে আসবে অনেক কলংকিত অধায়। হয়ত দলীয় সেনাপতিদের আমলা নামায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে মানবিক মেয়রের অনেক অমানবিক কর্মকান্ড যা আমরা সাধারণ জনগণ জানিনা।
নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়ে থাকলে অভিনন্দন নতুন মেয়রকে। আর যদি ২৪০০ ভোটের ব্যবধান ভোটারদের আইওয়াশ করার পুরানো কৌশল হয়ে থাকে, তাহলে একদলা থুথু ও ধিক্কার ছাড়া আর কিছু দেয়ার নেই। জাতীয় নির্বাচনের শতকরা ১০০ ভাগই যেখানে কলুষিত সেখানে স্থানীয় নির্বাচনে স্বচ্ছতার আশাকরা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় নরসিংদীতে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ নিজের গ্রহনযোগ্যতা ধরে রাখতে চাইলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। বছরের পর বছর ধরে জোর জবরদস্তি, ব্যালটবাক্স ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে একসময় জনরোষের মুখোমুখি হতে বাধ্য। পৃথিবীর দেশে দেশে যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। উদাহরণ হিসাবে আনা যায় এককালের শক্তিশালী ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তানের মুসলিম লীগ। সব বিচারে ঐ দল এখন লাশ হয়ে শুয়ে আছে কফিনে। চেতনার দোহাই দিয়ে রাজনীতির মাঠে বাকিদের দেশদ্রোহি আখ্যা দিয়ে পুলিশ, র্যাব, বর্ডার পুলিশ আর সেনাবাহিনীর কাধে ভর করে ক্ষমতার চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেয়া যায়না। এ ঐতিহাসিক সত্যের জ্বলন্ত স্বাক্ষী আজকের জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ সে পথেই হাটছে। আস্থা রেখেই বলা যায়, এ যাত্রায় গদি হারালে আওয়ামী লীগকে তার কর্মকান্ডের জন্যে চরম মূল্য গুনতে হবে। নির্বাচন হবে তার অন্যতম মাধ্যম।
অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় আসুক তাদের স্বাগত জানাতে আমরা বাধ্য। এটাই গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এর নামই গনতন্ত্র চর্চা। গায়ের জোরে প্রতিপক্ষ দল ও তার নেত্রীকে পঙ্গু বানিয়ে উন্নতির উল্লাস করে একদল স্তাবককে সন্তুষ্ট করা যায়, সবাইকে নয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক মূল্যবোধের সবকটা প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু বানিয়েছে। পাশাপাশি জন্ম দিয়েছে একদল তৃতীয় শ্রেনীর স্তাবকের দল। তৈরী করেছে ব্যাংক ডাকাত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বানিয়েছে ক্যান্টনমেন্ট। ক্যান্টিনমেন্টকে বানিয়েছে ভোগ-বিলাসের লীলাভূমি।
এ দেশ কারও বাবারও নয়, স্বামীরও নয়। এ দেশ সতের কোটি মানুষের। তারাই সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক ক্ষমতার মসনদে কাকে বসাবে। রাজা রানী আর যুবরাজ তৈরীর জন্যে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। এ দেশের জন্ম হয়েছিল একটা স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসাবে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক মর্যাদার নূন্যতম গ্যারান্টি নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে।