কায়সার দাঁড়িয়ে থাকে, নড়েচড়ে না! যেন পাথরই বা। এই একটু আগে, সূর্য যখন ডুবছে জলের নিচে, তখন তার পাঁচ বছরের ছেলে শাওন বাম হাত ধরে নাড়া দিয়েছিলাে একবার। ও হ! কি সুন্দর সানসেট! তাই না ড্যাড?
সাড়া দেয়নি কায়সার। তাতে কি, থামেনি শাওন, বলে যাচ্ছিলাে সূর্যটা জলের নিচে...। বলতে দেয়নি মেহেরুন, থামাে তাে। ডিস্টার্ব করাে না। বাবা, সূর্যাস্ত দেখছে। দেখাে, দেখাে কি সুন্দর! তখন থেকেই চুপ, শাওন। যােগ দিয়েছে মায়ের সাথে। সূর্যাস্তের দৃশ্যে।
সমুদ্র খুব প্রিয় মেহেরুনের। অনেক দিন থেকেই আসতে চেয়েছিলাে। কেবল কায়সারেরই সময় হয়নি। প্রাইভেট কোম্পানি।
কতাে যে কাজ! ফুরসত কই? তাছাড়া মেহেরুনও চাকরি করে। বেসরকারি হাই স্কুলে। ছুটিছাটা যদিও বা মেলে, দুজনের একসঙ্গে হয় না। তবু মেহেরুন খুঁচিয়েছে কম না, এবার শরতের ছুটিতে যেভাবেই পারাে, তােমার বসকে ম্যানেজ করাে। ৪ দিনের ছুটি নাও। কক্সাবাজার যাবাে। কায়সার বলে, ‘অফিসে ম্যালা কাজ। ছুটি পাওয়া...।
মেহেরুন ক্ষেপে যায়, ‘খালি কাজ আর কাজ। কবে তুমি ছুটি পাবে, বলাে? দুনিয়ার আর কোথাও কেউ যেন কোম্পানিতে চাকরি করে না। তাদের বিপদ-আপদ হয় না। প্রাইভেট লাইফ বলে কিছু থাকে না। ছুটিছাটা পায় না। যত্তো ঝামেলা শুধু তােমার বেলায়।
কায়সার বুঝে, ক্ষেপেছে মেহেরুন, পুরাে মাত্রায়। কিছু বললে আর থামানাে যাবে না। হেসে বলে, ‘ছুটি না হয়। বলে-কয়ে নিলাম। কিন্তু শরতে কেন? ডিসেম্বরে নিলে হয় না?
‘না’ মেহেরুন বলে, “ডিসেম্বরে শীত পড়ে। কুয়াশাও ঢের। সূর্যাস্তের দৃশ্যটা ভালােমতাে উপভােগ করা যায় না। শরতে আকাশ পরিষ্কার। স্বচ্ছ সুন্দর সূর্যাস্ত। দারুণ উপভােগ করা যায়। তারপর কণ্ঠ- যতােটা সম্ভব নরম করে বলে, সিরিয়াসলি বলাে না একবার। আমার বিশ্বাস ছুটি তুমি পাবেই এবং অন্তত দু’দিনের। কায়সার বলে, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে। শরত আসুক তাে আগে।'
স্কুল বন্ধ হলে কায়সার ভেবেই রেখেছিলাে, প্রতিবার যেমন বলে, ‘এতাে করে বােঝালাম বসকে। বিশ্বাস করাে মেহেরুন, কিছুতেই রাজি হলাে না। এতাে কাজ অফিসে...।' তারপর যা ঘটবে, কায়সার জানে। একটি কথাও বলবে না মেহেরুন। গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। দু’দিন ভালােমতাে কথাই বলবে না। কায়সারও মান ভাঙ্গাতে চেষ্টা করবে না। মুড নিয়ে থাকবে। এমনভাব দেখাবে যেন তার যাওয়ার ইচ্ছার বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলাে না । যতাে অনিষ্টের মূল অফিসের বেরসিক বস। খালি কাজ আর কাজ। উৎপাদন বাড়াও। বিক্রি বাড়াও। মুনাফা বাড়াও। আর হিসাব মিলাও- ডেবিট-ক্রেডিট। জীবনের হিসাব মিলুক আর না মিলুক ক্ষতি নেই। কে আর জীবনের সাধ-আহলাদ নিয়ে ভাবে! রােমাঞ্চকর মুহূর্ত! সমুদ্র সূর্যাস্ত নিয়ে ভাবে? মাস শেষে একতােড়া নােট পেলেই হলাে। একতােড়া নোটই জীবন। জীবনের সবকিছু।
মেহেরুনের রাগ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকবে। দুদিন পর কায়সার প্রস্তাব দেবে, কোনাে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে ঘুরে আসার জন্য। তাতেও মেহেরুনের মন অবশ্য ষােলআনা পাওয়া যাবে না। সময়-সুযােগ বুঝে আরাে দু’একদিন ঘুরতে হবে এদিক ওদিক - রমনা পার্ক, গাইড হাউস। তারপর স্কুল খুললে, মেহেরুন আবার সেই আগের মতােই স্বাভাবিক। তখন কে বলবে শরতের সমুদ্র সূর্যাস্ত দেখার জন্য মেহেরুন গাল ফুলিয়েছিলাে? কিন্তু এবার সপ্তাহখানেক আগেই মেহেরুন সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাে, স্কুল বন্ধ হচ্ছে বার তারিখ । তােমার বসকে ম্যানেজ করাে। ছুটি নাও। নতুবা এবার আমি একাই যাবাে সী-বীচে। শাওনকে নিয়ে।
তখনই কায়সার বুঝেছিলাে, এবার আর মেহেরুনকে থামানাে যাবে না। যাবেই যাবে। কী আর করা! বসকে রিকোয়েস্ট করে ছুটি নিতে হলাে দু’দিনের।
মেহেরুন আগেই গুছিয়ে রেখেছিলাে সব। গতকাল সন্ধ্যায় বাসে চেপে বসেছে। আজ সকালে এসে পৌঁছেছে। কক্সবাজার। বিলাস হােটেলের ২০৪ নম্বর রুমে যখন দু’দিনের জন্য উঠেছে, তখন সকাল ন'টা। শাওন জানালাে ক্ষুধার কথা। নাস্তা কায়সার হােটেল বয়কে দিয়েই আনিয়ে নিতে চায়। মেহেরুন বলে, দরকার কি বাবা? এসেছি ঘুরতে। ঘুরি। এক ঢিলে দুই পাখি মারি। নাস্তা করতে গিয়ে আশপাশের জায়গাটাও দেখে আসি, চলাে।
প্রস্তাব মন্দ না। ভালাে। তাছাড়া পকেটে হাত দিয়ে দেখে সিগারেটও নেই। কিনতে হবে এক প্যাকেট। ঘন ঘন সিগারেট টানা, মেহেরুন পছন্দ করে না। এসব জায়গায় অবশ্য কায়সারের সিগারেট না হলেও চলে না। বেয়ারার কাছে এক প্যাকেটের কথা শুনলে নিশ্চিত চেঁচিয়ে উঠবে, মেহেরুন। দরকার কি বাবা। কায়সার ভাবে, বাইরে গিয়ে, ফাঁক-ফোকর বুঝে নিজেই এক প্যাকেট কিনে ঢুকিয়ে রাখবাে পকেটে। ব্যস। তারপর যতাে খুশি টানাে। মেহেরুনের বকবক তখন কে শােনে! তবে তাকে চটানাে যাবে না। তাহলে, সিগারেটের পুরাে প্যাকেট ফেলে দেবে জলে। আর একটু ম্যানেজ করে চললে, কায়সার জানে মেহেরুন একটু বেশি কনসিডার করবেই করবে।'
বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিচে নামে তারা। তারপর সামনের পাকা রাস্তাটা পার হয়। সীবীচ রেস্টুরেন্ট। মুখের দিকে তাকাতেই মেহেরুন বলে, ‘ঢুকে পড়াে এটাতেই।
চেহারাসুরত ভালাে না হােটেলটার। ঝকমকহীন চেয়ার-টেবিল। তার মধ্যে গিজগিজ মানুষ। শাওন একবার বলে, ‘ভেরি ডার্টি ড্যাড। বেরিয়ে পড়তে চায় কায়সার। কিন্তু তেহারির চমৎকার গন্ধটা তখন নাকের ভেতর অনবরত ঢুকে যাচ্ছে। হয়তাে তার জন্য লােভ হয় মেহেরুনেরও। ছেলেকে চাপা গলায় ধমক দেয়, এভাবে বলতে নেই। দেখছাে না, কতাে মানুষ যাচ্ছেন। এর চেয়ে ভালাে হােটেল এখানে নেই। চুপ হয়ে যায় শাওন। হয়তাে গন্ধটা ওরও মনে ধরে খুব। তাছাড়া সামনের তিনজনের টেবিলটা খালি হয় তখন। বসে পড়ে তাতে। বেয়ারাদের একজন টেবিল পরিষ্কার করতে না করতেই আরেকজন রেখে যায় তেহারির প্লেট। বলা নেই, কওয়া নেই। যেন সবাই তেহারি খেতেই আসে এখানে! চারদিকে তাকিয়েও দেখে তাই। গরম গরম ধোয়া উড়ছে। আর গন্ধটা...।
প্লেটে হাত না দিয়ে পারে না কেউ-ই। ধীরে ধীরে খাচ্ছিলাে তেহারি। তারিয়ে তারিয়ে নিচ্ছিলাে স্বাদটা। খেতে খেতে হঠাৎ কাউন্টারে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে কায়সার। এক সুন্দরী ভদ্র মহিলা। তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। চোখে চোখ পড়তেই মহিলা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে রাখে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ৪/৫ বছরের একটি মেয়ের ওপর। তার পাশে এক ভদ্রলােক, হয়তাে মেয়েটির বাবাই, বিল মিটিয়ে দিয়ে তিনজনে বেরিয়ে যায় । যাওয়ার সময় মহিলাটি আরেকবার আড়চোখে তাকায়। তাতেই কেমন আনমনা কায়সার। খেতেই ভুলে যায়। শাওন ফিক ফিক হেসে ফেলে, “দেখাে মাম খাচ্ছে না ড্যাড। তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। মেহেরুন তখন ধমের সুরে বলে, ‘খাচ্ছে না কেন?
“আরে কই!' বলে কায়সার আবার তেহারিতে হাত দেয়। দ্রুত খাওয়া শেষ করে ওঠে। বেসিনে গিয়ে হাত ধােয়। তারপর বেয়ারার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে, ‘এক প্যাকেট ব্যানসন। বলে চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে। বিলের অপেক্ষায়। মেহেরুন আর শাওন তখন হাত ধুতে যাচ্ছে। তারা হাত ধুতে ধুতেই টেবিলে চলে আসে। বিল আর সিগারেট। প্যাকেট পকেটে ঢুকিয়ে বিল মিটিয়ে, কাউন্টারের সামনে দিয়ে, বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় কায়সার। যদি মহিলাকে আঁশপাশে কোথাও দেখা যায় ! না নেই কোথাও। পিছন ফিরে তাকায় সে। মেহেরুন আর শাওন আসছে। সিগারেট বের করে না। মহিলার সুখ তখন শূন্য ভেসে মিলিয়ে যায়। মেহেরুন এসে বলে। আমাদের ফেলে চলে এলে কেন?
‘চলে এলাম!’ কায়সার বলে, কোথায়?
‘আবার বলছাে কোথায়? মেহেরুন বলে, আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার আগে বেসিনে যাওনি? কোনাে কিছু না বলে এখানে এসে দাঁড়াওনি? ‘
এতাে রাগ করছাে কেন?' কায়সার হাসে, ভিতরে যা ভিড়! দেখছাে না লােকজন বসতেই পারছে না। একেবারে অস্বস্তিকর! শাওন বলে ‘ড্যাড ঠিকই বলেছে।
মেহেরুনের রাগ তখন পড়ে যায়, বলে, তবু এভাবে আসা তােমার উচিত হয়নি।
‘ঠিক বলেছাে। কায়সার বলেন, এবার হাঁটি।
‘কোথায় যাবে?
‘আপাতত রুমে।' কায়সার বলে একটু রেস্ট নিই, তারপর সী বীচে, কী বলাে?
‘ঠিক আছে।
রাস্তাটুকু পেরিয়ে তিনজনে ঢুকে পড়ে বিলাসে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উঠে আসে দোতলায়। রুমে ঢােকে। কায়সার চেয়ারে বসে সিগারেট ধরায়। মেহেরুন বলে, ওরে পাজি! এবার বুঝেছি। আগে বেরিয়ে সিগারেট কিনেছাে। তাও এক প্যাকেট! ও সিগারেট আমি...। কায়সার হেসে বলেন, 'ইটস দ্যা টাইম ফর এনজয়িং। প্লিজ!, মেহেরুন, ডােন্ট ডিস্টার্ব মি।
“ঠিক আছে। করলাম না। মেহেরুন বলে, তবে একটির বেশী নয় কিন্তু। পর্দা সরিয়ে দাও। ধোয়া বাইরে যাক। রুম দুর্গন্ধ করা চলবে না।
ওকে ম্যাডাম। কায়সার বলেন, “তােমার কথার অনড় হবে না।'
পর্দা সরিয়ে দেয় সে। মেহেরুন মিটি মিটি হাসে। কায়সার টান দেয় সিগারেটে। টেবিলের কোন হতে কাচের নীল অ্যাশট্রে এনে ছাই ফেলে। মেহেরুন ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সী বীচে যাওয়ার ড্রেস নির্বাচনে। আর সিগারেট টানতে টানতে কায়সার ভাবে, সেই মহিলার কথা, অমন চমকে উঠলাে কেন সে? ভয়ে নাকি বিস্ময়ে? আমাকে দেখে তাে কারাে ভয় পাবার কথা নয়। চেহারায় কোনাে রূক্ষতা নেই। নাকি আছে? না, নেই। অবশ্য অনেকেরই তা থাকে। দেখলেই গুণ্ডাপাণ্ডা মনে হয়। হােক সে মনে প্রাণে ভদ্র লােক। তবু মানুষ তাকে ভয় পায়। কিন্তু তার ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি সুঠাম দেহের কোথাও একটুও গুণ্ডামি বদমাইশির ছায়া আছে, কেউ তা বলতে পারবে না। তাহলে ওভাবে তাকিয়ে ছিলাে কেন সে?
বিস্ময়ে? অবশ্য মানুষের কাছে যা কিছু অসাধারণ, তা দেখে কিংবা শুনেই মানুষ বিস্মিত হয়। আমি তাে অসাধারণ কেউ নই। অত্যন্ত সাদামাটা একজন মানুষ। আমাকে দেখে তাে কারাে বিস্মিত হওয়ার কথা নয়। অবশ্য মহিলাকে দেখে আমিও চমকে উঠেছিলাম, দৃষ্টি সরাতে ভুলে গিয়েছিলাম, কেন? কায়সার ভাবে, কোথা যেন দেখেছি তাকে? মেহেরুন তখন বলে ওঠে, ‘কোন রঙের ট্রাকসুট পরবে তুমি! নীল না কালাে? শাওন বলে, আমার চয়েস ব্লু কালার। গেঞ্জিও তাই।
মেহেরুন বলে, ‘বেশি বােঝ না। কালাের সাথে সাদাও চমৎকার। তারপর কায়সারের দিকে এই কোনটি পছন্দ তােমার? বললে, মহিলার মুখ মিলিয়ে যায়। কায়সার তখন বুড়াে আঙ্গুলে সিগারেট টোকা দিয়ে ছাই ফেলে, বলে, ‘ব্লুই থাক। শাওন বলে, ড্যাড ইজ ভেরি গুড। মেহেরুন কিছু বলে না। কায়সার তখন সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মহিলার মুখ মনে করার চেষ্টা করে। পুরােপুরি ভেসে ওঠার আগেই, মেহেরুন বলেন, “আর কতাে সিগারেট টানবে। দশটা বিশ।'
কায়সার ধোয়া ছেড়ে বলে, ‘শেষ। তৈরি হয়ে নাও।
অ্যাশট্রেতে সিগারেটের বাকি অংশটুকু খুঁজে উঠে দাঁড়ায় কায়সার। তারপর পােশাক চেঞ্জ করে বেরিয়ে পড়ে। রিকশা নেয়। সােজা সী-বীচ।
ফকফকা আকাশ। কোথাও এক চিলতে কালাে মেঘ নেই। মৃদু মন্দ বাতাসে। শীত শীত লাগে। ঢেউ আছে সাগরে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে আছড়ে পড়েছে তীরে। অসংখ্য মানুষ। তীরের অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ বসে, সমুদ্র দেখছে। ঝাপিয়ে পড়ছে অনেকে। জলে ডুবছে ভাসছে। সাঁতার কাটছে।
জেলে নৌকা। জাল ফেলছে। জাল তুলছে। মাছ ধরছে। শত শত ক্যামেরা লুফে নিচ্ছে সে সব দৃশ্য। তা দেখতে দেখতে শাওন খুব উচ্ছ্বসিত, ভেরি বিউটিফুল সিনারি!
তারপর রিকশা থেকে নেমে প্রায় দু'শ গজ বালু পথ মাড়িয়ে তীরে এসে পৌছে তিনজনে।
‘স্যার! ছবি তুলবেন?’ হাতে ক্যামেরা ঝােলানাে দু’জন তরুণের একজন বলে, ‘একবারে ঝকঝকে ছবি। মনের মতাে না হলে পয়সা দেবেন না, স্যার।
‘না’। কায়সার বলে, ক্যামেরা সাথেই আছে।
মেহেরুন ততক্ষণে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে বলেন, বাপ-বেটা দাঁড়াও তাে! ফাস্ট সাপটা আমিই নেই। তরুণ দু’জন চলে যায়। অন্য কোথাও। কায়সার আর শাওন দাঁড়িয়ে পােজ দেয়। মেহেরুন ছবি তােলে। পরপর কয়েকটি। তারপর ক্যামেরা হাত বদলায়। কায়সারের। শাওনের। ছবি উঠে, মা ছেলের, স্বামী-স্ত্রীর। বসে দাঁড়িয়ে জলে নেমে, ঢেউয়ের মাঝে আছড়ে পড়ে, সাঁতার কেটে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। একজনকে রিকোয়েস্ট করে তিনজনের ছবিও ক্যামেরাবন্দি হয়। কায়সার বলে, চলাে।
শাওন বলে, না। আরা কিছুক্ষণ থাকবাে।।
মেহেরুন বলে, 'যাও। উপরে বসাে গিয়ে। আমরা আসছি।
তাড়াতাড়ি করাে।' কায়সার বলে, বেশি বাইরে যেও না। চোরাবালি আছে। সাগরও টেনে নিয়ে যেতে পারে, দূরে, ঢেউয়ের টানে।
মেহেরুন বলে, “আচ্ছা যাবাে না। সেই খেয়াল আছে।
কায়সার উঠে আসে জল থেকে। বসে পড়ে, হাত পা ছড়িয়ে বালির ওপর। ক্লান্ত। তবু শাওন আর মেহেরুনকে দেখে, বেশি দূর যায় কিনা। আর দেখে সাগর। নীল নীল ঢেউ।
মানুষের কোলাহল। পৃথিবীর সব আনন্দ-বেদনা যেনাে এখানে এসে মিশে গেছে একই জল তরঙ্গে। প্রতিটি টেউয়ের গর্জনই যেন এক একটি অনুভূতি, এক একটি ভাষা। মগজে খালি নাড়া দিয়ে যায়। তারপর হঠাৎ সে, দেখে, সেই তিনজন মানুষ, অদূরে জলের ভেতর থেকে উঠে আসছে। উচ্ছ্বসিত মানুষের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে। উল্লসিত মেয়েটির হাত দুপাশে থেকে দু’জনে ধরা। মহিলার গােলাপি সিল্পের শাড়ির ভেজা আঁচল নির্ভাজ হয়ে বুকের ওপর লেপ্টে আছে। বুকের ঢালটুকুও স্পষ্ট। গােলাপি ব্লাউজ ঠেলে ব্রা’র কালাে রঙটাও বেরিয়ে পড়েছে নিঃসঙ্কোচে। ঘাড়ের ওপর আছড়ে পড়া ভেজা চুল। চুইয়ে চুঁইয়ে বুকের ওপর গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল, যেনাে মুক্তোই।
মহিলাটি তাকায় কায়সারের দিকে। কায়সারও। সরায় না চোখ। আকেরটি ঢেউ এসে তাদের ভিজিয়ে দেয়। তখন। মেয়ে ও বাপ আনন্দে ফেটে পড়ে, হা... হা...। মহিলাটি হাসে কিনা বােঝা যায় না। শুধু তার দৃষ্টি কোণিকভাবে স্থির কায়সারের উপর। কায়সার মনে মনে বলে, শিমু না!'
আরাে কাছে এগিয়ে আসে তারা। মহিলাটির উপরের ঠোটের মাঝখানে সামান্য ওপরে, একটি তিল। ‘হ্যা। কায়সার নিজের সাথে নিজেই ফিসফিস করে এতাে শিমুই। নাকি অন্য কেউ? না...না...।
মহিলাটির বন্ধ ঠোট তখন সামান্য ফাঁক হয়ে কাঁপতে থাকে। ‘মা’ মেয়েটি ডাকে। সে কোনাে জবাব দেয় না। মেয়েটি তার হাত ধরে। সে কোনাে জবাব দেয় না। মেয়েটি তার হাত ধরে। মৃদু ধাক্কা দেয়। কোনাে সাড় নেই। শুধু চোখ জোড়া একবার নত হয়ে পড়ে মেয়ের ওপর। তারপর প্রায় কায়সারের পাশ ঘেঁষে চলে যায় তারা। কায়সার শুনতে পায়, ছেড়া ছেড়া কণ্ঠ, আব্দু। ছােট্ট মেয়েটি বলে, ‘ছবিগুলাে... আম্মু না সেই কখন থেকে...।
‘কই, কই? দেখি...। পুরুষ লােকটির কণ্ঠ। মহিলাটির চড়া গলা, মনি, তুমি কিন্তু খুব...।
‘হি. হি. হি...।' মনির হাসি। আর কারাে কণ্ঠ শুনতে পায় না কায়সার। কিন্তু তার সামনের ফ্রেমে ঝুলে থাকে জলরঙের জলভেজা একটি মুখ। স্থির। শিমুর।
শিমু? হ্যা, শিমু। কায়সারের মনে পড়ে যায়, গােপীবাগের শিমু। শিল্পী শিমু। যার গান শােনার জন্য সে চারতলা ব্যাচেলর রুমে, দক্ষিণের জানালার পর্দা সরিয়ে, প্রতিদিন ভােরে দাঁড়িয়ে থাকতাে, সেই শিমু। যদিও তাদের মধ্যে কথা হয়নি কোনােদিনও। তবু চোখে চোখে অনেক কথাই হয়ে গিয়েছিলাে এবং তা সম্পর্কে গড়ানাের আগেই মহল্লার মস্তানদের উৎপাতে একদিন, হঠাৎ, তারা বাসা ছেড়ে চলে যায় কোথায়, কায়সার জানে না। তারপর তার সাথে আর দেখাও হয়নি কোথাও, কোনােদিন। তাও প্রায় বার-তের বছর। তবু কায়সার আশা ছাড়েনি। গানের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে বসে থাকে টিভির সামনে। নতুন মুখ দেখলেই নিরিখ করে, শিমু কিনা। পত্রিকার বিনােদন পাতায় খুঁজে, শিমুর মুখ । পায় না.....।
শুধু সে কেন? তখন তার চারপাশের লােকজনও বলতাে, যা গলা! অমন মেয়ে নামকরা শিল্পী না হয়ে যায় না। কিন্তু কোথাও কোনাে প্রােগ্রামে তাকে আজো দেখলাে না কায়সার। এই খচখচানি কখনাে কখনাে তার বুকের মাঝে খুব বেশি বেজে ওঠে। ব্যাপারটা সে কিছুতেই অ্যাভয়েড করতে পারে না। যদিও তার সংসার আছে, অফিসের কাজে প্রায়ই ব্যস্ত থাকতে হয়, তবু সব কিছু ছেড়ে নিজেকে যখন নিজের মুখােমুখি দাঁড় করায়, তখন মাঝখানে বসে শিমু সুর তােলে, আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি......। এমন মেয়ে গান ছেড়ে দিলে চলে? কেন ছেড়ে দিলাে গান? এসব ভাবতে ভাবতে কায়সার দেখে শাওন আর মেহেরুন উঠে আসছে উপরে।
মেহেরুন এসে বলে, ‘ইচ্ছে করছিলাে না উঠি।
‘উঠলে কেন?
‘টায়ার্ড লাগছে খুব। মেহেরুন বলে, ‘চলাে এবার রুমে ফিরে যাই।
‘আমার কিন্তু এখনাে যেতে ইচ্ছে করছে না, ড্যাড।
‘কেন?
আরাে কিছুক্ষণ জলে থাকতে ইচ্ছে করছে।
‘না না। মেহেরুন বলে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তারপর কায়সারের দিকে তাকিয়ে, ‘উঠোতাে দেরি করাে না। কায়সার উঠে। হাঁটা শুরু করে। মনিরা তিনজন, কায়সার দেখে, তখনাে বালিপথটুকু পেরােয়ানি। দ্রুত পা বাড়ায় সে। যদি ধরা যায়! যদি কথা বলে! অন্তত জানা যাবে কী করে, কোথায় থাকে, কোথায় উঠেছে; তাও যদি সম্ভব না হয়, দেখতে তাে পাবে তাকে আরেকবার।
আরাে তাড়াতাড়ি পা চালায় কায়সার। মেহেরুন ও শাওন পেছনে পড়ে। দূরত্ব বাড়ে....।
‘এই শােন। মেহেরুন ডাকে এতাে জোরে হাঁটছাে কেন?’ কায়সার বলে, আসাে তাড়াতাড়ি, আমি গিয়ে রিকশা ঠিক করি।'
‘এতাে তাড়া কিসের তােমার? মেহেরুন বলে, “দাঁড়াও।
কায়সারকে তখন থামতেই হয়। মেহেরুন ও শাওন হাত ধরাধরি করে কাছে আসার আগেই, কায়সার দেখে, তারা রিকশায় চেপে বসেছে। বাকি পথটুকু পেরিয়ে স্ট্যান্ডে আসতেই তাদের রিকশা টুং টাং শব্দে ছুটে যায়। অবশ্য, রিকশা ছুটে যাওয়ার আগে, বাঁক নেয়ার সময় মহিলাটি আরেকবার দেখে নেয় কায়সারকে। সে তখন মনে মনে বিরক্ত হয়, মেহেরুন ও শাওনের উপর। কেন এতাে দেরি করলাে ওরা?’
মহিলাদের রিকশা তখনাে মিলিয়ে যায়নি, চেষ্টা করলে ধরা যায়। একটি রিকশায় তারাও উঠে বসে তিনজন। কায়সার হুকুম দেয়, ‘বিলাস হােটেল। টানাে...।
রিকশাঅলা টানতে চায় জোরেই। কিন্তু পারে না। সমুদ্র স্নান শেষে ছুটে আসছে অনেকেই। রিকশা ঠিকঠাক দরদাম নিয়ে ছােট জটলার মতাে হয়েছে। সেটি পার হতে হতে তারা কোথায়, কোন্দিকে মােড় নেয়, কায়সার লক্ষ্য রাখতে পারে না; হারিয়ে ফেলে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। হয়তাে তার ছায়া পড়ে চেহারায়ও। মেহেরুন বলে, ‘মুডে আছাে।
না, না, কই!’
‘অনেকক্ষণ চুপচাপ।
‘একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল....।
‘ওহ! এখানে এসেও তােমার অফিস? একদম মাথায় আনবে না। খবরদার।
‘এসে যে পড়ে।
‘জাহান্নামে যাক।
কায়সার হাসে। কতাে সহজে একজনের ভেতর আরেকজন যাওয়া-আসা করে। কতাে সহজে মানুষ তাকে। আড়াল করতে পারে। মেহেরুন তুমি জানে না। জানেনা কি? কায়সার ভাবে। মেহুেরুন বলে, যতােক্ষণ এখানে আছাে, এখানেই থাকবে। এ নিয়েই ভাববে। অন্য কোনাে ভাবনা যেন মাথায় না আসে আর।
‘তা কি পারে কোনাে মানুষ? কায়সার ভাবে। মেহেরুনের দিকে তাকিয়ে। এখনাে রেগে আছে সে। অল্পতেই রেগে যায় মেহেরুন। আবার অল্পতেই ঠাণ্ডা। শাওন বলে, ‘ড্যাডকে বকছাে কেন, মাম?
কই বকলাম, কই?
‘বকেছাে।'
‘দেখছাে না, তােমার ড্যাড খালি অফিস অফিস করে।
রিকশা এসে থামে। বিলাস হােটেলে। নেমে পড়ে তিনজন।
ভাড়া মিটিয়ে দেয় কায়সার। তারপর সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঠে আসে দোতলায়। রুমে ঢুকে। গােসল করে। ফ্রেশ হয়। ম্যানেজারকে রিং করে জানিয়ে দেয়, খাবারের মেন্যু।
রূপচাঁদা, সাদা ভাত, সজি, ডাল। কিছুক্ষণ পর, হােটেল বয় নিয়ে আসে তা।
খেতে খেতে মেহেরুন বলে, ‘রূপচাদাটা খুব সুন্দর বেঁধেছে ওরা।
হুম। কায়সার বলে।
যাওয়ার সময় কেজি পাঁচেক নিতে হবে। ‘
শুটকি না কাঁচা?
‘দুটো মিলিয়েই। রূপচাদাকে ইংলিশে কি বলে, মাম?
‘জানি না, ড্যাডকে জিজ্ঞেস করাে।
‘এখন খাও। পরে বলবাে।
বেসিনে চলে যায় কায়সার। মেহেরুন আর শাওনও। হাত ধুয়ে কায়সার এসে বসে চেয়ারে। জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে সিগারেট জ্বালায়। মেহেরুন ফিরে এসে বলে, ‘আবার সিগারেট?
‘একটাই।
শাওন বেড়ে গিয়ে শুয়ে পরে। মেহেরুন গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘রেস্ট নাও। সূর্যাস্তটা কিছুতেই মিস করা যাবে না।' ‘
তা তাে অবশ্যই। কায়সার বলে। তারপর সিগারেটে লম্বা টান দেয়। টানে টানে ভেসে উঠে শিমুর মুখ । মহিলার মুখ। না, অমিল নেই কোথাও। তবে একটু মােটা। বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়। এই যা। তবু মানুষের চেহারাসুরত আজীবন কি একই রকম থাকে? তারপর ঘুমন্ত মেহেরুনের দিকে তাকিয়ে ভাবে, বিয়ের পর কতাে বদলে যায় না? সিগারেট শেষ। আরেকটা জ্বালায় কায়সার। ভাবে, শিমু হলেই বা আমি কি করতে পারি? কথা বলবাে? সে কি চিনবে? চিনলেও কি কথা বলবে? না, না হয় না। এখনাে তা হয় না, আমাদের সমাজে। বসে থাকতে আর ভালাে লাগে না কায়সারের। ক্লান্তি লাগে। ঘুম পায়। সিগারেট ফেলে জানালার গুটানাে পর্দা ছড়িয়ে দিয়ে বেড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বুজে আসে চোখ....।
বিকালে ঘুম ভাঙে মেহেরুনের ডাকে।
‘যে জন্য সী-বীচে আসা, মেহেরুন বলে, সেটাই মিস হতে চললাে। ড্রেস-আপ করে রেডি মেহেরুন ও শাওন। কায়সার বলে, “আরাে আগে ডাকবে তাে?
‘ডাকিনি আবার! পড়ে পড়ে খালি ঘুমােচ্ছাে। নাও তাড়াতাড়ি উঠো। তৈরি হয়ে নাও।
বাথরুমে চলে যায় কায়সার। ফিরেও আসে তাড়াতাড়ি। শার্ট-প্যান্ট পরে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সী-বীচে এসে দেখে, সূর্য ডুবছে সমুদ্রের ভেতর। জলের ওপর আলাের নাচন, তখনাে, ঢেউ ভেঙে ভেঙে গজে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। কতাে শতাে মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে সেই অপরূপ দৃশ্য। দৃষ্টি সরাচ্ছে না কেউ। যেন মগ্নচৈতন্যে সবাই। কায়সারও ডুবে যেতে থাকে সেই দৃশ্যে। ডুবে যাওয়ার আগেই দেখে, তার ডানপাশে সেই তিনজন। মহিলাটি তার কাছেই। আড়চোখে তাকে ফাঁকে ফাঁকে দেখছে। কায়সারও তাকায় মাঝে মাঝে। খুঁজে অবিকল একজন শিমুকে।
কায়সারের বাম হাত এখনাে ধরে আছে শাওন। শাওনের পাশে মেহেরুন। মহিলাটির ডানপাশে ছােট্ট মেয়েটি। পাশে তার বাবা। আর সব অপরিচিত মানুষ। সবাই সূর্যাস্তে মেতে। তাদের সাথে মেতে উঠতে চায় কায়সারও। পারে না।...
‘হায় খােদা! এই সূর্যাস্ত সাক্ষী। কায়সার মনে মনে বলে, ‘আমি মেহেরুনকে ভালােবাসি। আমি আমার সন্তানকে ভালােবাসি। অন্য কারাে জন্য আমার যেন কষ্ট না হয় আজ। আর আমি বিশ্বাস করি, সে শিমু নয়। তার প্রচ্ছায়া।
সূর্য ডুবে গেছে। আঁধার নামছে। হু হু বইছে ঠাণ্ডা বাতাস। লােকজন চলে যাচ্ছে। মেহেরুন বলে, চলাে যাই। ‘চলাে”। বলে কায়সার হাঁটা শুরু করে। যেতে যেতে সে শুনতে পায়, পুরুষ কণ্ঠ, ‘এখনাে দাঁড়িয়ে কেন, শিমু? চলাে চলাে। তারপর মেয়েটির কণ্ঠ, ‘আম্মু বলেছে, আজ গান শােনাবে।
পুরুষ কণ্ঠ ‘ওসব শােনার সময় আছে নাকি? কায়সারের বুকের ভেতর সামুদ্রিক হাওয়া। ফেনিয়ে ওঠে নােনাজল। ঢেউয়ে ঢেউয়ে। প্রবল জোয়ারে। সেখানে সাঁতার কাটে যে, সে এক মৎস্য কন্যা।
— অনলাইন থেকে সংগৃহীত
লেখকঃ সমীর আহমেদ