শুক্রবারের রাত! আজকের রাতটা আর দশটা শুক্রবার রাতের মত নয়। বিষণ্ণতার রাজত্ব চারদিকে। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, খেলার মাঠ, পার্ক, কোথাও মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই। শহরে কার্ফু জারী করেনি, কিন্তু তাতে কি! সচেতনাই মানুষকে ঘরে আটকে রাখছে। ঘরের অবস্থাও সুবিধার নয়। টিভির নিউজ চ্যানেলগুলো দেখার মত অবস্থা নেই। দেখলে গা চমকে উঠে। শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। আমার মত যারা কর্পোরেট দুনিয়ার মানডে টু ফ্রাইডে'র চাকর তাদের কাছে শুক্রবার রাতটা হচ্ছে স্বপ্নের রাত। এমন প্রতিটা রাতই মনে হয় প্রেয়সীর বাহু-লগ্না হয়ে হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাস পড়ার রাত। অত্যন্ত গেল শুক্রবার পর্যন্ত তাই ছিল।
আজকের রাত ও আজকের পৃথিবী মনে হয় ভিন গ্রহ হতে উড়ে আসা একদল এলিয়েনদের ঠিকানা। বাসার পাশের শপিং-মল আর শুঁড়িখানার ঝলমলে বাতিগুলো অতীত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানা না থাকলে মনে হবে বিশাল একটা দৈত্য শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মানুষ হ্যামিলনের বংশীবাদকের পিছু নিয়ে হারিয়ে গেছে মহাকালের কক্ষপথে।
পাঁচদিনে একবারও বাড়ির মূল ফটক খুলিনি। মন চাইলে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে নিয়েছি পরিচিত পৃথিবীটাকে। আমার বিশেষ কোন অসুবিধা হয়নি। কারণ আমি ঘরমুখো মানুষ। অতিরিক্ত কোলাহল আমাকে বিকর্ষণ করে। কিন্তু আমার দুই সন্তানকে এসব বুঝানো যায়না। ওরা অস্থির হয়ে আছে বাইরে যাওয়ার জন্যে। মেয়েটার স্কুল আজ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছে। তার মন খারাপ। বন্ধুদের জন্যে কান্নাকাটি করছে।
ছেলেটা যতক্ষণ সজাগ ততক্ষণ প্রশ্ন করছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই বের হলাম। সিদ্ধান্ত ছিল গাড়িতে থাকবো সবাই। যতদূর সম্ভব ড্রাইভ করে ওদের মন ভাল করে ফিরে আসবো। কিন্তু স্থানীয় কসকো স্টোরটার কাছে আসতেই নতুন এক ভয় চেপে বসলো। কি হবে যদি আমাদের আরও কয়েক মাস এভাবে কাটাতে হয়!
পার্কিং লটে শত শত গাড়ির জায়গার ৩/৪টা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পেট্রোল পাম্পটা শূন্য। তেলের দাম অর্ধেকেরও নীচে নেমে গেছে। গ্যালন প্রতি ১.৩৪ ডলার। হঠাৎ মনেহলো বাসায় গ্রোসারীর যথেষ্ট রিজার্ভ নেই। রিস্ক নিয়েই দোকানটার দিকে সবাই মিলে রওয়ানা দিলাম।
শত শত ট্রলি এতিমের মত লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নেওয়ার মত মানুষ নেই। মুল ফটকে একজনকে পাওয়া গেল। মলিন একটা হাসি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো। একজন ট্রলির হাতলটা স্প্রে করে হ্যান্ড টাওয়েল দিয়ে মুছে দিল। ভেতরে পা রেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। অলমোষ্ট কেউ নেই! অথচ স্বাভাবিক দিনে এখানে মানুষের হাট জমে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক কিছু কিনে যখন বের হলাম অন্ধকারের চাদরে ছেয়ে গেছে গোটা শহর।
দূরে সান্দিয়া পাহাড়ের পাদদেশের বাড়ি গুলোও আজ অন্ধকার দেখালো। শহরের বিরান রাস্তা দিয়ে আজ আর ওভার স্পীডিং করার ইচ্ছা করলো না। বোবার মত অন্ধকারের প্যানোরমা দেখতে দেখতে কখন বাসায় পৌঁছে গেছি টের পাইনি। ততক্ষণে বাচ্চারাও ঘুমিয়ে পরেছে ভৌতিক শহরে কোন এক ধাবমান গাড়ির পিছন সীটে।