বড্ড বিচিত্র ও জটিল জেরুজালেমের সমীকরণ। ১৯৬৭ সালের ৫ই জুন হতে ১০ই জুন এই ৫ দিনের যুদ্ধে নির্ধারিত হয়ে যায় তিন ধর্মের পবিত্রতম এই শহরের ভাগ্য। জাতিসংঘের ম্যান্ডেটে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েলকে তার প্রতিবেশী আরব দেশগুলো মেনে নিতে পারেনি। জন্মের শুরু হতেই শুরু হয় বৈরিতা।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধ ছিল অবিশ্বাস, অস্থিরতা ও স্ব স্ব ভাগ্য নির্ধারণের যুদ্ধ। যুদ্ধের শুরুটা ছিল মিশর ও সিরিয়ায় ইসরায়েলিদের প্রিএমটিভ এয়ার ওফেনসিনভের মধ্যদিয়ে। পাশাপাশি গ্রাউন্ড ওফেনসিভ শুরু হয় সানাই পেনিনসুয়েলা, গোলান হাইটস, গাজা স্ট্রিপ ও পশ্চিম তীর আক্রমণের মধ্যদিয়ে। অপ্রস্তুত আরব দেশগুলো ৫ দিনের বেশী চালাতে পারেনি এ যুদ্ধ। মাত্র ৫ দিনের যুদ্ধে মিশর হারায় সানায়, সিরিয়া হারায় গোলান হাইটস, গোটা পশ্চিম তীর ও জর্ডান নদী চলে যায় ইসরায়েলিদের দখলে। এই যুদ্ধেই ইসরায়েলিরা দখল নেয় জেরুজালেমের।
দরকষাকষির পর মিশরীয়রা তাদের হারানো এলাকা ফিরে পেলেও, সিরিয়া ফিরে পায়নি তার গোলান হাইটস, জর্ডানিদের হাতছাড়া হয় জেরুজালেম। প্যালেষ্টাইনিদের স্বাধীন সত্ত্বা অনন্তকালের জন্যে অন্তরীণ হয় ইসিরায়েলিদের খাঁচায়।
আমার ইসরায়েল সফরের প্রায় সবটাই কেটেছে পূর্ব জেরুজালেমে। প্যালেষ্টাইনিদের স্বপ্ন ছিল একদিন স্বাধীন প্যালেষ্টাইনের জন্ম হলে জেরুজালেম হবে তাদের রাজধানী। সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। বাস্তবতার ধারে কাছেও যায়নি। স্বপ্ন সংকুচিত হয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় পূর্ব জেরুজালেমে। পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যস্থতায় দরকষাকষি চলছিল গোটা জেরুজালেম নয়, পূর্ব জেরুজালেমই হবে ভবিষ্যৎ প্যালেষ্টাইনের রাজধানী। তার সবটাই ছিল ইসরায়েলের পাশাপাশি প্যালেস্টাইন নামের নতুন এক রাষ্ট্র গঠনকে ঘিরে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের একজন হোয়াইট সুপ্রেমিষ্ট ওভাল অফিসে বসার পর বদলের যায় দুই রাষ্ট্রের বাস্তবতা। বদলে যায় জেরুজালেম শহরের ভাগ্য। রাতারাতি ইসরায়েল তার রাজধানী তেল আবির হতে সরিয়ে নিয়ে আসে জেরুজালেমে। ট্রাম্প প্রশাসন রাতারাতি স্বীকৃতি দেয় এই পরিবর্তন।
মধ্যপ্রাচ্যের কুখ্যাত রাজা-বাদশার দল ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে যোগ দেয় ট্রাম্প শিবিরে। সরে আসে তাদের ট্র্যাডিশনাল প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের সমর্থন হতে। এভাবেই সাহসী হয়ে উঠে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বাস্তু দেশ ইসরায়েল।
গোটা পশ্চিম তীরকে গ্রাস করে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসার নীল নকসা হিসাবে স্থাপন করেছে বিশাল এক দেয়াল। এ দেয়াল পার হয়ে পশ্চিম তীর হতে প্যালেষ্টাইনিদের জেরুজালেমে প্রবেশ করায় অনুমতি নেই। খোদ পশ্চিম তীরে ডি-ফ্যাক্টো রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকার মত অবস্থায় নেই প্যালেষ্টাইনিদের। এলাকার গোটা জনগণ এখন বন্দী। কাজ নেই। মাথার উপর অনেকের ছাদ নেই। শরণার্থী শিবিরগুলোতে অনাহার, অবহেলায় বেড়ে উঠছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্যালেষ্টাইনি শিশু।
হতাশা আর অনিশ্চয়তা হতে পশ্চিম তীরের ঘরে ঘরে জন্ম নিয়েছে প্রতিশোধের আগুন। ওখানকার ১০ বছরের একজন শিশুকে তার স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করলে সে নির্দ্বিধায় বলে দেবে, বুকে বোমা বেধে ইসরায়েলের কোন শহরে নিজকে উড়িয়ে দেয়া।
অধিকৃত প্যালেষ্টাইনের অস্থায়ী রাজধানী রামাল্লা অথবা যীশু খ্রিষ্টের জন্মস্থান বেথলেহামের রাস্তায় হাঁটলে মনে হবে আর দশটা জনপদের মতই এখানকার জীবন। কিন্তু কারও সাথে কথা বললেই বেরিয়ে আসে ওখানকার আসল জীবন। ওখানে জীবন আছে, কিন্তু নেই সে জীবনের কোন ছন্দ। শিশু জন্ম নেয় নিজ ঘরে একজন শরণার্থী হয়ে। ওখানেই বেড়ে উঠে এবং মৃত্যুও হয় ওখানে। মাঝখানের জীবন স্বপ্ন-হীন কতগুলো বছর মাত্র।
রামাল্লায় প্যালেষ্টাইনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অফিসে গিয়েছিলাম দেখা করার জন্যে। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম একদিন প্যালেষ্টাইনিদের স্বপ্ন পুরুষ চেয়ারম্যান আরাফাতের সাথে দেখা করতে যাব। কথা বলবো তাদের জীবন নিয়ে। প্যালেষ্টাইনে যাওয়া হয়েছে ঠিকই, দেখা হয়নি ইয়াসির আরাফাতের সাথে। মাহমুদ আব্বাসও সময় দিতে পারেননি। কারণ ঠিক সময়টায় ইসরায়েলিরা ১০০ প্যালেষ্টাইনি পরিবারকে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্য নিয়ে হামলে পরেছিল পশ্চিম তীরে।
হয়ত পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপে থেমে যাবে চলমান ইসরায়েলি নৃশংসতা। পশ্চিম তীর ও গাজা সহ পূর্ব জেরুজালেম ফিরে পাবে তাদের স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু এ স্বাভাবিক জীবন যে প্যালেষ্টাইনিদের স্থায়ী জীবন নয়, তা বুঝতে পারবেনা বাকি বিশ্ব। কারণ প্যালেষ্টাইনিরা তাদের অস্তিত্বের জন্যেই লড়াই চালিয়ে যাবে আরও হাজার বছর।
ছবি: পূর্ব জেরুজালেমের আল হাশমি হোটেল। ব্যাকগ্রাউন্ডে আল আকসা মসজিদ