কাহিনীর ভেতর কাহিনী...

Submitted by WatchDog on Saturday, May 22, 2021

ইসরায়েল

যে গুটিকয়েক পাঠক আমার লেখার সাথে থাকেন তাদের হয়ত জানা হয়ে গেছে এ কাহিনী। বার বার লিখেছি। ছবি দিয়েছি। আবারও লিখছি কারণ সময়টা এখন অন্যরকম। গোটা বিশ্বের মানুষ প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখছে তার সাথে কিছুটা হলেও সামনে হতে দেখার সুযোগ হয়েছে। খুব কাছ হতে দেখা হয়েছে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জীবন। আল আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসরাইয়েলি সৈন্যদের টিয়ার গ্যাসের বর্বরতার সামনে আমি সহজে দাঁড় করাতে পারি ওখানকার প্রতিদিনের পরিবেশ। গোধূলি বেলায় কমপ্লেক্সের স্বপ্নীল পরিবেশ। চারদিকের নৈসর্গিক স্তব্দতা, সীমাহীন পবিত্রতা আর জড়ো হওয়া মানুষের ফিসফাস শব্দ যে কাউকে নিয়ে যাবে হাজার বছর আগের আল আকসায়। কান পাতলে হয়ত শোনা যাবে মুসলিম ধর্মের বিবর্তনের অনেক অজানা কাহিনী।

নাব্লুস হতে আসা দুজন প্যালেস্টাইনি কিশোরের সাথে পরিচয় হয়েছিল ওখানে। ওরাই এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিল ছবি তুলতে সাহায্য করতে পারে কিনা। আমার অনুসন্ধানি মন দেরী করেনি জিজ্ঞেস করতে তাদের কাহিনী। এক বাক্যে ওরা বলেদিয়েছিল সবকথা, 'আমরা কে তা কারও জানা নেই'। নেই কোন পাসপোর্ট। কোথাও লেখা নেই জন্ম আমাদের প্যালেষ্টাইনে।"

মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসরায়েলিদের অভিযান পূর্ব জেরুজালেমের মুসলমানদের জন্যে নতুন কিছু নয়। এর আগে বহুবার তা ঘটেছে। ইসরায়েলি জেনারেল ও পরবর্তীতে দেশটার প্রধানমন্ত্রী খোদ এরিয়েল শ্যারন একবার সদলবলে ঢুকে ছিলেন মসজিদে। গোট প্যালেস্টাইন জুড়ে ছড়িয়েপরা দ্বিতীয় ইন্তেফাদার ক্যাটালিষ্ট হিসাবে কাজ করেছিল এই ইন্ট্রুশন। লম্বা হয়েছিল সে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। শত শত প্যালেস্টাইনি প্রাণ হারিয়েছিল। বিশ্ব অসহায় হয়ে দেখেছিল ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর বর্বরতা।

কিছুটা ভয় ও অনিশ্চয়তা নিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের দামেস্কাস গেট হতে রামাল্লাগামী বাসে চড়েছিলাম। নিশ্চিত ছিলামনা আমার মার্কিন পাসপোর্ট না মুসলমান পরিচয় কোনটা ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করবে। প্যালেস্টাইন তথা গোটা পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলিরা নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আলাদা করে রেখেছে ইসরায়েলের মূল ভুখন্ড হতে। অথচ রামাল্লার উঁচু কোন দালানের ছাঁদে উঠলে সহজে চোখে পরে আল আকসা মসজিদের চূড়া। লাখ লাখ প্যালেস্টাইনিদের দেয়াল অতিক্রম করে জেরুজালেমে প্রবেশের অনুমতি নেই। কিছু মানুষ যাদের অনুমতি আছে স্থানীয়দের মতে ওরা ইসরায়েলিদের দালাল। মূল ভুখন্ডে যায় তথ্য বিক্রির আশায়।

দামেস্কাস গেট হতে ৩০ মিনিট বাস জার্নির পর চোখে পরবে ভয়াবহ একটা দেয়াল। ওটাই পশ্চিম তীরে ঢুকার সীমান্ত। এর আগে আমি বহুবার বহুদেশের সীমান্ত অতিক্রম করেছি। যার মাঝে ছিল ভয়াবহ বার্লিন দেয়াল। কিন্তু জেরুজালেম হতে পশ্চিম তীরে প্রবেশ করতে তেমন কিছুই চোখে পরলনা। লম্বা ট্রাফিক জ্যাম...যাত্রীবাহী বাস, নড়বড়ে হরেক রকম যানবাহনের কাফেলা মনে করিয়ে দেয় সামনে কোন ঝামেলা আছে।
না, তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই নীরবে প্রবেশ করলাম প্যালেস্টাইনে।
দেয়ালের এ পাশে দখলকরা জেরুজালেম আর ওপাশে লাখ লাখ প্যালেস্টাইনিদের বন্দী শিবির পশ্চিম তীর।

দেয়ালের ওপাশে প্রথম যা চোখে পরল তা প্রায়ত নেতা ইয়াসির আরাফাতের একটা ছবি। কাঁচা হাতে আঁকা। সাথে আরবীতে লেখা কিছু বক্তব্য। না বুঝলেও ধারণা করা যায় প্যালেস্টাইনিদের ভালবাসার খেড়োখাতা।

আমার বাসটা একটু উঁচু হলে সহজে দেয়ালের দুই পারের জীবনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মাপতে পারতাম। রামাল্লায়ও উঁচু উঁচু দালান আছে। কিন্তু নেই তেল আবিবের দালানগুলো চাকচিক্য। জীবন এখানে স্বাভাবিক নয় বুঝতে খুব একটা সময় লাগেনা।

শরনার্থী শিবিরগুলো শহরের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। ট্যুর গাইড ইচ্ছা করেই ওখানটায় নিয়ে গেল আমাকে। এবং তা পায়ে হেঁটে। অস্থায়ী কোন ব্যবস্থা নয়, পাকা দালান। ভিতরে উকি দিতেই ফুটে উঠল আসল চেহারা। বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন বিহীন শরনার্থী শিবিরের জীবন চাইলে ২য় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়।

মানুষ বেঁচে থাকে পশ্চিম তীরে। কিন্তু কোন স্বপ্ন নেই সে বেঁচে থাকায়। নেই কোন প্রত্যাশা। আমার ট্যুর গাইডের স্ত্রী অসূস্থ। তার চিকিৎসার ঔষুধ আসে মিশর হতে। তার জন্যে সাহায্য নিতে হয় স্মাগলারদের। এভাবেই বেঁচে থাকে প্যালেস্টাইনিরা। একই চিত্র ঐতিহাসিক শহর জেরিকো ও বেথেলহামে। আমার মত কিছু ট্যুরিষ্ট আসলেও তাদের গতিবিধি থাকে নিয়ন্ত্রিত। তাদের অনেকেই এখানে রাত কাটায়না। ভয় একটাই, যেকোন মুহূর্তে প্রতিবাদ প্রতিরোধের স্ফূলিংগ অস্থির করে তুলতে পারে গোটা পশ্চিম তীরের জীবন। ট্যুর গাইডের উপদেশেই রাত কাটানো হয়নি প্যালেস্টাইনে।

আসল বাধাটা আসলো পশ্চিম তীর হতে জেরুজালেমে ঢোকার পথে। আবারও সে দেয়াল। তবে এ যাত্রায় প্রতিটা বাসকে থামতে হলো। জলপাই পোশাকের ইসরায়েলি সৈন্য বাসে উঠে একে একে সবার পরিচয় চেক করলো। জানতে চাইলো ইসরাইয়েলে প্রবেশের কারণ। ইচ্ছা করেই চোয়ালটা শক্তকরে অন্যদিকে তাকিয়ে তুলে দিলাম মার্কিন পাসপোর্ট। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে যাইনি এই অমানুষিকার আসল শক্তির উৎস। ভুলে যাইনি আমার ট্যাক্স ডলারের একটা অংশ এই সৈনিকের কাধে ঝুলানো অটোমেটিক রাইফেল কেনার পুঁজি।

কোন ঝামেলা ছাড়াই পা রাখলাম জেরুজালেমে। সূর্য ততক্ষনে পশ্চিম দিগন্তে হেলে পরেছে। প্যালেস্টাইন দেখার লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ার উত্তেজনা তখন মগজে বাসা বাধেনি। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক হতে। চারদিকের সবকিছু শান্ত দেখালেও আমি জানতাম এটাই এ অঞ্চলের আসল চিত্র নয়। যেকোন মুহূর্তে দাউ দাউ আগুনের মত ছড়িয়ে পরতে পারে প্রতিরোধ। পশ্চিম তীরে যে ক'জনের সাথে কথা হয়েছে তাদের সবার একই কথা, এটাই আসল প্যালেস্টাইন নয়!

ভালো লাগলে শেয়ার করুন