একশ জাতির একটা সমাবেশে বন্দুকের নলের মুখে যদি কেউ আমাকে আল্টিমেটাম দেয় দুই মিনিটের ভেতর রুশদের আলাদা করতে না পারলে গর্দান যাবে, আমিও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারবো, দুই মিনিট কেন এক মিনিটেই ওদের আমি আলাদা করে ফেলবো...
অবশ্যই পারবো। ওদের চেহারা, মুখের একটা শব্দ অথবা শরীরের ভাষা পড়েই বলতে পারবো ঐ ব্যাটা রুশ।
ইসরায়েল বাউন্ড ফ্লাইটে পা রাখার আগেই ঐ দেশটায় রুশদের বসবাসের উপর সম্যক একটা ধারণা নিয়েছিলাম। এ ব্যপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল আমাদের সবার পরিচিত গুগল মামা।
অবশ্য এ ব্যপারে গুগল ছাড়াও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও কমতি ছিলনা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আমাদের ক্লাশে ২৬ জনের ভেতর ৩ জন ছিল রুশ ইহুদি। ইশ্বর প্রদত্ত স্পেশাল ব্রেইন নিয়ে জন্ম এই ৩ জন ক্লাশে নিজেদের উপস্থিতি সবার আগে জানান দিত।
একে একে এই তিন জনের সবাই রহস্যজনকভাবে উধাও হওয়া শুরু করলে ব্যপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করি।
অবশ্য এ রহস্য উদঘাটনে শার্লক হোমস হওয়ার দরকার হয়নি। ক্লাশের বাকি রুশদের সাথে আলাপ করে জানা গেল উধাও হওয়ার কাহিনী। ওরা সবাই ইসরায়েলের উদ্দেশে জন্মভূমি ত্যাগ করেছে।
ইমিগ্রেশন ঝামেলা চুকিয়ে তেল আভিভ-ইয়োফো এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে আসতে রাত হয়ে গেল। হবে হয়ত ১০ টা।
আমার হোটেলটা ডাউন টাউন এলাকায়। ভূমধ্য সাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে।
হোটেল বুক করার সময় ট্যাক্সি চাইতে ওরাই উপদেশ দিয়েছিল এয়ারপোর্ট হতে নিতে। তাতে নাকি খরচ অনেক কম পরবে।
ডিরেকশন মত ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ডে এসে বুঝতে পারলাম আসলেই তাই।
ট্যাক্সি ক্যাবের লম্বা লাইন। যাত্রী তেমন নেই।
নিউ ইয়র্কের কেনেডি ও লা গুয়ারডিয়া এয়ারপোর্টের মত অর্গানাইজড।
হাতে লাইট নিয়ে মাতবরগোছের একজন লাইন কন্ট্রোল করছে।
মিনিট খানেকের ভেতর আমার লাইন এসে গেল।
ড্রাইভারের চেহারা দেখে যা বুঝার বুঝে নিলাম। রুশ!
আলোকময় পরিচ্ছন্ন ফ্রীওয়ে ধরে ট্যাক্সি এগিয়ে চলছে শহরের দিকে। চুপচাপ বসে আছি পেছনের সীটে। বাইরের পৃথিবী দেখার চেষ্টা করছি। কিছু একটা বাধা আসলে সামনের ড্রাইভার গাই গুই করছে আর ক্ষণে ক্ষণে গালি দিচ্ছে।
ব্যাটা বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করেনি রুশ ভাষায় গালাগালিতে আমি এন এক্সপার্ট হেডমাষ্টার।
বিরামহীন গালাগালিতে ধৈর্য ধরে একটু কষ্ট হল। এক পর্যায়ে সারেন্ডার করতে বাধ্য হলাম।
প্রথমে একটা কাশি দিয়ে তার মনযোগ আকর্ষণ করলাম। পর মুহূর্তে কোন ভণিতা না করে বলে ফেললাম; চু*রানীর পো, এই বিদেশে বিভুঁইয়ে এসেও রুশ সংস্কৃতি বদতালে পারিসনি...
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বরসি রমানসেভ (ড্যাশ বোর্ডে তার নাম ঝুলছিল)। হো হো করে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলো; তুই রুশ ভাষা শিখলি কোত্থাকে, তাও আবার খাঁটি উচ্চারণে?
ওরা এমনই। কথার শুরু ও শেষকরে বাপ-মা'কে গালি দিয়ে। উত্তরে গালি দিলে রাগ করেনা, বরং খুশি হয়। কাউকে সহজে আপন করে নিতে গালির নাকি কোন বিকল্প নেই।
আধা ঘণ্টার ক্যাব জার্নির সবটাই কাটল তার বকবকানি শুনে। তাতে অবশ্য আমারই উপকার হলো। হরেক রকম টিপস দিল কোথা হতে শুরু করে কোথায় শেষ করতে হবে আমার ইসরায়েল জার্নি।
রাত প্রায় ১১টার দিকে শূণ্য শহরের এক গলিতে এসে আমাকে নামিয়ে দিল। আশাতিরিক্ত টিপস পেয়ে একটু অবাক হল।
৩৮ বেন ইয়াহুদা স্ট্রীটের উপর হোটেল সেন্ট্রালের (מלון סנטרל) নিয়ন সাইনটা নিভু নিভু করছে। হয়ত বোর্ডারদের সবাই ঘুমের আয়োজন শেষকরে ফেলেছে।
কলিং বেল টিপে বেশকিছুটা সময় অপেক্ষা করার পর সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। কম করে হলেও ৩টা সিকিউরিটি লক ওপেন করার পর মূল ফটক খট করে খুলে গেল।
মাথায় ইহুদি টুপি পরিহিত কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি।
চেহারা দেখে সেকেন্ডের ভেতর তার পরিচিতি আবিস্কার করে ফেললাম। রুশ!
আবারও গালি। এবং মা বাবাকে নিয়ে।
এ যাত্রায় গালিটা ফিরিয়ে দেয়া হতে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
নতুন দেশ। নতুন পরিবেশ। গোটা ইসরায়েলে রাজত্ব করে একধরণের ভয়। দেশটায় নতুন কেউ পা রাখলে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করে অনেকে। অনেক সময় পিছু নেয় গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ।
এ যাত্রায় হাসি দিয়ে রুমের চাবি চাইলাম। হাতে চাবি ধরিয়ে অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় জানিয়ে দিল হোটেলে এখন ঘুমের সময়। অতিরিক্ত কোন আওয়াজ সয্য করা হবেনা।
ভেতরে ভেতরে সাবধান হয়ে গেলাম। খুব দ্রুতই সিদ্বান্ত নিলাম এ হোটেলে এটাই হবে আমার শেষ রাত।
অবশ্য পরদিন দুপুর ১২টার ভেতর শুধু হোটেল না, তেল আভিভ শহর ত্যাগ করে রওয়ানা দিয়েছিলাম জেরুজালেমের দিকে। এবং সফরের বাকি সময়টা ওখানে অবস্থান করে একে একে ঘুরে এসেছিলাম পশ্চিম তীরের রামাল্লা, বেথেলহেম সহ আরও অনেক শহরে।