ইউক্রেইন সীমান্তে ১ লক্ষ ২৭ হাজার রুশ সৈন্য মোতায়েন করেছে রাশিয়া। এবং অপেক্ষা করছে ক্রেমলিনের নির্দেশের। সন্দেহ নেই নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পরবে প্রতিবেশী দেশে। মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে খুব শীঘ্র এই অনুপ্রবেশ ঘটতে যাচ্ছে।
কেন এই সৈন্য সমাবেশ, কেনই বা সামরিক অভিযান, সোভিয়েত দেশের পতন ও রুশ ফেডারেশনের উত্থান সম্পর্কে যাদের জানা নেই তাদের জন্যে ব্যপার গুলো ধাঁধার মত মনে হবে। কারণ ইউক্রেইন তার পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর সীমান্তে এমন কোন উস্কানিমূলক প্ররোচনা দেয়নি যার জন্যে লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে তুলনামূলক দুর্বল একটা দেশ আক্রমণ করতে হবে। কিন্তু রুশরা তাই করতে যাচ্ছে।
প্রতিটা যুদ্ধের পেছনে থাকে কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড, থাকে প্রিটেক্সট। ২০১৪ সালে একই কায়দায় রুশরা ইউক্রেনে প্রবেশ করেছিল এবং ক্রিমিয়ার দখল নিয়ে নিজেদের অংশ দাবি করে রুশ ফেডারেশনের সাথে একত্রীভূত করেছিল। ঐ যুদ্ধের প্রিটেক্সট ছিল ক্রাইমিয়ায় বসবাসকারী রুশরা। এই এনেক্সসেশন ক্রিমিয়ার এক বিশাল জন-গুষ্টি সমর্থন করেছিল, যাদের সবাই ছিল রুশ।
ক্রাইমিয়া দখল পশ্চিমা বিশ্ব সমালোচনা করলেও রুশদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ঢিলেঢালা অর্থনৈতিক অবরোধ কাজ করেনি বিভিন্ন কারণে। প্রথমত, মার্কিনীদের আফগান ও ইরাক যুদ্ধ। তৃতীয় একটা দেশের বিরুদ্ধ গ্রাউন্ড অফেন্স শুরু করার মত শক্ত অবস্থায় ছিলনা মার্কিন অর্থনীতি। দ্বিতীয়ত, রুশদের পারমানবিক সক্ষমতা। তৃতীয়ত, পশ্চিমা বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক অনৈক্য ও গণতন্ত্রের অনিশ্চিত যাত্রা।
২০১৪ সালের সফল ইউক্রেইন আক্রমণ নিশ্চিতভাবে রুশদের মনোবল শক্তিশালী করেছিল। তার রেশ নতুন এই সৈন্য সমাবেশ এবং সম্ভাব্য আক্রমণ। সন্দেহ নেই ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ছিল রুশদের ইগোতে চপেটাঘাতের সামিল। ১৯১৭ সালের কথিত সর্বহারাদের বিপ্লবের নামে প্রতিবেশী জাতিসত্তাগুলোকে অস্ত্রের মুখে নিজেদের ইউনিয়নে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল ভ্লাদিমির উলিয়ানভের পেশি শক্তি। প্রায় ৭৫ বছর ধরে এর মূল্য গুনতে হয়েছে ইউক্রেনিয়ার মত জাতি গুলোকে। স্বাভাবিকভাবেই ১৯৯১ সালে ফিরে পাওয়া স্বাধীনতা তারা উপভোগ করতে শুরু করেছিল নিজেদের মত করে।
রুশরা মেনে নিতে পারেনি ১৯৯১ সালের বিপর্যয়। এই বিপর্যয় এক সময় পরাক্রমশালী দেশটাকে নামিয়ে আনে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনের মসনদে নিজের দখল পাকাপোক্ত করার পর নজর ফেরান নিজেদের হারানো 'গৌরব' ফিরে পাওয়ার দিকে। মিশনের অংশ হিসাবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে একে একে নিজেদের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসানোর পাশাপাশি বৈরী দেশগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক সমাবেশ ঘটিয়ে উস্কানি দেয়া শুরু করেন তিনি।
জনগণের ম্যান্ডেট উপেক্ষা করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ সমাজের কায়দায় অগণতান্ত্রিক, একনায়ক-তান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের বসিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার মিশন শুরু করে রুশরা। প্রতিবেশী বেলারুশ ও কাজাকিস্তান তেমনি দুটি দেশ যেখানে বছরের পর বছর ধরে ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতায় আছেন অ্যালেক্সান্ডার লুকাসেঙ্কো ও কাসসেম-জোমার্ত তোকায়েভের মত স্বৈরাচারী শাসকরা। কাজাকিস্তানে তোকায়েভ ক্ষমতায় থাকলেও পিছন হতে কলকব্জা নাড়ছেন অন্য এক রুশ পুতুল নুর-সুলতান নজরবায়েভ ও তার তিন লুটেরা কন্যা।
রাশিয়া কোন মানদণ্ডেই এখন আর পরাশক্তি না। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের সংস্করণ মাত্র। নিজদের শূন্য কলস ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হারানো 'গৌরব' ফিরে পাওয়ার কামনা বাসনা হতেই ইউক্রেইন আক্রমণের পায়তারা। পুতিন গংরা ভাল করেই জানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি কোন আক্রমণ প্রতিহত করতে পালটা আক্রমণে যাবেনা। এ যাত্রায় রুশরা ইউক্রেইন আক্রমণের প্রিটেক্সট হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে দেশটার ন্যাটোতে যোগদান। পুতিন সরকার বলছে বার্লিন দেয়াল অপসারণ ও দুই জার্মানী একত্রিভূত করার সময় পশ্চিমারা কথা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে বিচ্ছিন্ন দেশগুলোকে ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত করা হবেনা।
যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা অনেক দেশ হতে প্রচুর সামরিক সাহায্য যাচ্ছে ইউক্রেইনে। বিশেষজ্ঞদের মতে এর উদ্দেশ্য পালটা আক্রমণ করে রুশদের পরাজিত করা নয়, বরং যুদ্ধ বেধে গেলে তা দীর্ঘায়িত করা, রুশদের সামরিক ব্যায় ব্যাপক হারে বাড়ানো এবং পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে পুতিনকে একঘরে ফেলা।
ইউক্রেইনে রুশ বিরোধী মনোভাব জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায় যুদ্ধ শুরু হলে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশটার সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসবে। পাশাপাশি এ যুদ্ধ প্রতিবেশী বেলারুশ, জর্জিয়া ও কাজাকিস্তানের মত সেন্ট্রাল এশিয়ার অনেক দেশে এন্টি-রুশ মনোভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরতে সাহয্য করবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটাই হতে যাচ্ছে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন ষ্ট্রাটেজি। শর্ট টার্মে এ কৌশল খুব একটা কাজ না দিলেও লং-টার্মে রাশিয়াকে নখ-দন্তহীন কাগুজে বাঘে পরিণত করতে সাহায্য করবে।