শনিবার ১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল।এত বছর পেরিয়ে গেলেও দিন তারিখ সাল সব আমার মনে আছে। আর দশটা দিনের মত সেদিনও আমাদের ক্লাস ছিল।
এপ্রিল হলেও শীতের তীব্রতায় সামান্যতম ভাটা পড়েনি। এ এক আজব পৃথিবী। সাত আট মাস শীত থাকে। বরফের নীচে তলিয়ে যায় রাস্তা-ঘাট, নগর-বন্দর সবকিছু। নদী জমে বরফ হয়ে যায়। এবং জমাট বরফের উপর ট্রাক ঘুরে বেড়ায়। তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হিমাংকের নীচে চল্লিশ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়।
সিনিয়র ইয়ারে আমি। দেড় বছর পর কোর্স শেষ এবং ঘরে ফেরার পালা। প্রতিবছর সামার ব্রেকের আগে প্রাকটিক্যাল কোর্সে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় আমাদের। কখনও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কন্ট্রোল রুমে, কখনও বিতরণ নেটওয়ার্কের প্রটেকশন সিস্টেমে।
এবছরের জন্যে নির্ধারণ করা হয়েছে বিদ্যুৎ জেনারেশন পয়েন্টে তিন সপ্তাহের ক্রাশ কোর্স। আমাদের ২৬ জনের গ্রুপকে কয়েক-ভাগে বিভক্ত করে পাঠানো হবে বিভিন্ন পাওয়ার স্টেশনে।
আমি সহ আরও বেশ কজন নাম লেখালাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে। ইউক্রেইনের চেরনোবিল হবে আমাদের ঠিকানা।
জানুয়ারিতে নাম লিখিয়ে অপেক্ষায় আছি তারিখ ও দিনক্ষণ জানার। মার্চের মাঝামাঝি সময় ডিপার্টমেন্ট হতে আমাকে জানালো এ যাত্রায় আমার চেরনোবিল যাওয়া হবেনা। কারণ ওটা সোভিয়েত ষ্ট্রাটেজিক ইন্টারেস্ট পয়েন্ট। ওখানে বিদেশীদের যাওয়ার অনুমতি নেই।
অবাক হইনি। কারণ বিদেশী হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে আমাদের চলাফেরা কতটা সীমিত তার সাথে সম্যক পরিচিত হয়ে গেছি।
গ্রুপের বাকি সবাইকে মে মাসের শেষদিকে তৈরি থাকার জন্যে বলা হল।
২৬শে এপ্রিল বাকি সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল এ বছর কেউ যাচ্ছেনা ইউক্রেইনের চেরনোবিলে।
এ নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ না থাকায় কারণ জানতে চাইনি।
ঘরে ফিরে ডিনারের পর অন্যদিনের মত আজও রেডিওতে বিবিসির রুশ প্রোগ্রাম শোনার জন্যে নব ঘোরাতে শুরু করলাম।
খবরটা শুনে খটকা লাগা শুরু হল। চেরনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। রেডিওএক্টিভ মেটিরিয়াল পূর্ব ইউরোপের আকাশ অতিক্রম করে পশ্চিম ইউরোপের দিকে ধেয়ে আসছে।
খবরের হেডলাইন শোনার দশ সেকেন্ডের মাথায় বিবিসির রুশ প্রচারে বিঘ্ন দেখা দিল। বুঝতে অসুবিধা হল না রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে জ্যাম করে দিয়েছে বিবিসির প্রচার। রাত গড়ানোর সাথে ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচে বেল্লা সহ আরও কয়েকটা অনুষ্ঠান শোনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। কেবল রুশ ভাষার নয়, ইংরেজি সহ সব ভাষার প্রচারণা আটকে দিয়েছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ।
শেষরাতের দিকে ইসরায়েলি রেডিওতে ঘটনার উপর কিছুটা ধারণা পেতে সক্ষম হলাম।
শনিবার রাত গড়িয়ে দিন হল, রোববার কেটে গেল...সোভিয়েত প্রচার মাধ্যমে সামান্যতম কোন খবর নেই। বুধবার রাতে ৯টার খবরের শেষদিকে সংবাদ পাঠাক এক মিনিটের একটা প্রতিবেদনে জানালেন 'মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পশ্চিমা দোসররা' চেরনোবিল নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তেমন কিছুই নাকি ঘটেনি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে। সবটাই পশ্চিমাদের ধারাবাহিক এন্টিসোভিয়েত প্রচারণার অংশ।
সোমবার সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম হয়ত সহপাঠীদের সবাই জেনে গেছে চেরনোবিলে কি ঘটেছে।
হতাশ হলাম। কারও সামান্যতম ধারণা নেই কি ঘটেছে অথবা ঘটতে যাচ্ছে ওখানটায়।
ভাবলাম ডীন অফিসে গেলে হয়ত আসল খবর পাওয়া যাবে।
ওখানে প্রশ্নটা করে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম। খোদ ডীন তার অফিসে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
'তোর মায়রে...চু*DI, পশ্চিমাদের এই অপপ্রচার এ দেশে ছড়াবি তো তোকে আজ রাতেই ঢাকাগামী ফ্লাইটে উঠিয়ে দেবো'।
এবার আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে গেছে। কারণ সত্য ধামাচাপা দেয়ার সোভিয়েত কৌশলের ততদিনে আমি এন এক্সপার্ট হেডমাস্টার।
ঘটনাটা মনে পরল আজকের খবরে একটা একটা ইন্টারভিউ দেখে।
বাবা মস্কোতে আর তার ছেলে ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভে।
ছেলে বাবাকে ফোন করে বিদায় জানাচ্ছে কারণ তার বাঁচা মরা এখন অনিশ্চিত।
বাবা ছেলেকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে পুতিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার না চালানোর জন্যে শাসাতে লাগলো।
ছেলে অনেকটা সময় চুপ করে বাবার মিথ্যাগুলো শুনে গেল।
শুধু যাওয়ার আগে বলে গেল, বাবা, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আর যদি দেখা না হয় জেনে রেখো আমি তোমাদের সবাইকে ভালবাসি।