ব্যক্তিগত একটা গল্প দিয়েই শুরু করি লেখাটা। কথা দিচ্ছি খুব একটা লম্বা করবোনা।
স্তেলার সাথে পরিচয়টা ছিল অনেকটা প্রি-এরেঞ্জেড। আমার রুমমেট আন্দ্রেই শনিবার ক্লাসে যাওয়ার আগেই বলে রেখেছিল সন্ধ্যায় যেন কোথাও না যাই। তার সাথে একটা অপরিচিত জায়গায় যেতে হবে। নিজের সেরাটা প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিয়েই যেন তৈরি থাকি এমন একটা তাগাদাও ছিল।
আন্দ্রেই সেন্ট পিটার্সবার্গে নতুন। এসেছে প্রশান্ত মহাসাগরের রাশান দ্বীপ সাখালিন হতে। বড় শহরে আসার আগে সে কোনদিন বিদেশীর সাথে কথা বলা দূরে থাক, সামনে হতেও দেখেনি। আমি নাকি প্রথম এবং তা-ও আবার রুম-মেট হিসাবে।
রাতে একটা পার্টিতে যেতে হবে। মেয়েদের পার্টি। পার্টি করার মত যথেষ্ট ছেলে নেই তাদের হাতে। আন্দ্রের গার্ল-ফ্রেন্ড তাদেরই একজন। দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ছেলে যোগাড়ের। আমি তাদেরই একজন।
ওখানেই আন্দ্রের মাধ্যমে পরিচয় স্তেলার সাথে। গায়ে গতরে একফোঁটা চর্বি নেই, যা রুশ মেয়েদের জন্যে কিছুটা অস্বাভাবিক। সে রাতে বলতে গেলে হুর-পরীদের আসর জমেছিল। সৌন্দর্যের রহস্য উন্মোচন করতে অবশ্য খুব সময় লাগেনি। মেয়েদের সবাই ছিল স্থানীয় ব্যালে স্কুলের ছাত্রী।
এ প্রফেশনে আসতে শরীর ও সৌন্দর্য ছিল বাধ্যতামূলক। জমায়েত মেয়েদের কারোরই ঘাটতি ছিলনা এসবের।
স্তেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর ধরে নিয়েছিলাম লৌকিকতা রক্ষার জন্যে কিছুটা সময় ব্যায় করে ও চলে যাবে অন্য ধান্ধায়।
সে রাতে তা আর ঘটেনি। গভীর রাত পর্যন্ত এক সেন্ডের জন্যে সে আমাকে ছেড়ে যায়নি। আপনি হতে তুমি পর্যন্ত আসতে খুব একটা পথ পাড়ি দিতে হয়নি। এবং লম্বা এক কাহিনীর শুরু হয়েছিল সে রাতেই।
শনিবার বিকেল হলেই যে চলে আসত আমার এখানে। জানালার নীচে দাঁড়িয়ে বরফের ঢিল ছুড়ে জানান দিত নিজের উপস্থিতি। আমিও তৈরি হয়ে নীচে নেমে যেতাম।
আর দশটা রুশ মেয়ের মত সে নৈশ-ক্লাব, রেস্তোরা অথবা ভদকা পার্টিতে না গিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেত ব্যালে অনুষ্ঠানে। ঢুঁ মারতো স্থানীয় ফিলারমনিতে। পরিচয় করিয়ে দিত চাইকোভস্কি, সেস্তাকভিচের কম্পোজিশনের সাথে। নিজের উচ্চাশা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো না। তারও ইচ্ছা একদিন চাইকোভস্কির সোয়ান লেকের মূল চরিত্রে সে নাচবে।
এভাবেই ঘুরে গেল বছর। ততদিনে আমার অস্তিত্বের সবকিছুতে স্তেলার উপস্থিতি অবিচ্ছেদ্য। শনিবার সন্ধ্যা মানেই আমাদের।
হঠাৎ এক শনিবার তার আর দেখা নেই। আমি তৈরি হয়ে অপেক্ষায় আছি তার ঢিলের। কিন্তু না...বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল তবু তার দেখা নেই।
একটু অবাক হলাম। এমনটা হওয়ার কথা নয়। ধরে নিলাম নিশ্চয় শরীর খারাপ।
পরের শনিবারেও দেখা নেই। এবং তারপরের শনিবারেও না। অপেক্ষার প্রহর লম্বা হতে আরও লম্বা হওয়া শুরু করল। শীতের পর বসন্ত এলো এবং বসন্তের পর গ্রীষ্ম। যেন হালকা বাতাসে মিলিয়ে গেল জলজ্যান্ত একটা মেয়ে।
আস্তে আস্তে মেনে নিলাম এই অন্তর্ধান। ধরে নিলাম নিশ্চয় অন্য কারও বাহু-লগ্না হয়েছে ততদিনে। পৃথিবীর এ প্রান্তে এসব নিয়ে হা হুতাশ করার অবকাশ ছিলনা। আমিও হেঁটে গেলাম আমার পথে।
ধীরে ধীরে মুছে গেল স্তেলার স্মৃতি। আমার রুম-মেট আন্দ্রেই কোন হদিস দিতে পারল না।
প্রায় দেড় বছর পর সন্ধান পেলাম স্তেলার। সে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। ঠিকানা দেখে চমকে উঠলাম, হাইফা, ইসরায়েল।
আন্দাজ করতে পেরেছিলাম সে ইহুদি। কিন্তু এ নিয়ে কোনদিন প্রশ্ন করিনি। নিজেই লিখেছে ইসরায়েল যাওয়ার কারণ। গোটা পরিবার ইতালি হয়ে পাড়ি জমিয়েছে ওদিকে। তার একমাত্র ভাই এখন ইসরায়েল আর্মির সৈনিক। নতুন বয়ফ্রেন্ডও রুশ ইমিগ্রান্ট এবং সে সেনাবাহিনীর মেজর।
এবার আসি এ লেখার মূল পর্বে।
ইসরায়েল নামের দেশটার মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ভাগ রুশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ছলেবলে ওরা দেশ ছাড়তো। অনেক সময় ওদেরও ঠেলে দিত দেশের বাইরে। ইহুদিরা সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল ২য় শ্রেণীর নাগরিক। সমাজের সর্বক্ষেত্রে ওরা ছিল অবহেলিত। প্রতিটা রুশ ইহুদির কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ছিল একসময় ইসরায়েল চলে যাওয়া।
প্যালেষ্টাইনিদের দরদে উথলে উঠছে রুশ স্বৈরশাসক ভ্লাদিমির পুতিনের মন। তার এই মায়া অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরছে ধর্ম-প্রিয় বাংলাদেশিদের মন। তাই রুশদের ইউক্রেইন আক্রমণে অনেক স্বদেশী জেহাদের মত কলম লড়াই করছেন রুশদের হয়ে। অনেকের জন্যে কারণ একটাই, প্যালেষ্টাইনিদের প্রতি রুশ সমর্থন ও ইউক্রেইন প্রেসিডেন্টের অন্য শিবিরে অবস্থান।
এখানেই আসে স্তেলা, তার ভাই ও নতুন বয়ফ্রেন্ডের কাহিনী।
ফার্স্ট জেনারেশন রুশ ইহুদিদের অনেকেই নাম লেখায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে। তাদের মিশন এক ও অদ্বিতীয়; প্যালেস্টাইনিদের নির্মূল।
পশ্চিমে একটা কথা চালু আছে; ইসরায়েলি বর্বরতায় অর্থ ও অস্ত্রের যোগানদাতা যদি আমেরিকা হয় তবে সে অর্থ দিয়ে কেনা অস্ত্র চালাতে যে মানব সম্পদের দরকার হয় তার মূল যোগানদাতা রাশিয়া।
রুশ ইহুদিদের অনেকেই হাতে অস্ত্র নিয়ে হামলে পরে প্যালেস্টাইনি শিশুদের উপর। আকাশ হতে গুড়িয়ে দেয় গাজার বাড়ি-ঘর। পুরস্কার হিসাবে পায় প্যালেস্টাইনি এলাকায় সম্পত্তি। ওখানেই সেটলার হিসাবে বিষের কাঁটা হয়ে বাসকরে প্যালেষ্টাইনিদের নাকের ডগায়।