রুশদের ইউক্রেইন অভিযানের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে দেশটার আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এমন একটা অভিযোগ আনছেন যা এক অর্থে অশ্রুত ও অবিশ্বাস্য। তিনি বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেইন আক্রমণের অন্যতম কারণ হচ্ছে ডি-নাজিফিকেশন করা। অর্থাৎ, ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জালিনস্কি হচ্ছেন হিটলারের উত্তরসূরি নব্য নাৎসি এবং তাদের মিশন হচ্ছে তা নির্মূল করা।
খুবই অবাক করা অভিযোগ। কারণ জালিনস্কি নিজে ইহুদি, তার পরিবার ইহুদি, তার মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী ডেনিস আনাতোলিভিচ স্যামহালও একজন ইহুদি।
ইউরোপে নাৎসিবাদ উত্থানের মূল প্রিটেকস্ট ছিল ইহুদি প্রভাব হতে মহাদেশকে মুক্তা করা। এমন মিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিটলার ও তার দোসররা ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। যা ছিল ঐ মহাদেশে ইহুদি জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ।
খুন হওয়া ৬০ লাখ ইহুদি উত্তরসূরিদের একজন আজকের ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে নাৎসিবাদ বিস্তার করছেন জনাব জালেনস্কি, এমনটাই অভিযোগ রুশ প্রেসিডেন্টের। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে যা বিশ্বাস করা খুব কঠিন।
দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, পুতিনের অভিযোগে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে। আধুনিক ইউক্রেইন আসলেই নাৎসিবাদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড। এর গোঁড়া জানতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
লভিভ পশ্চিম ইউক্রেইনের মূল শহর। সোভিয়েত সময়ে এর পরিচিতি ছিল লবভ হিসাবে। ১৯১৮ হতে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এ শহর সহ পশ্চিম ইউক্রেইনের এ অঞ্চল ছিল পোল্যান্ডের অংশ। শহরের নাম ছিল LWOW। ১৯৩৯ সালে স্তালিনের রেড আর্মি দখল নেয় ঐ অঞ্চলের এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসাবে ঘোষণা করে। এই দখলে জার্মানদেরও ভূমিকা হিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের দখিলে চলে যায় এ অঞ্চল এবং Lemberg নামে নিজেদের অংশ হিসাবে ঘোষণা করে তারা। পশ্চিম ইউক্রেইনবাসী হিটলার বাহিনীকে স্বাগত জানায় নিজেদের মাটিতে, যার কারণ ছিল সোভিয়েত দখলের সময় স্তালিন বাহিনীর ভয়াবহ নির্মমতা।
১৯৪১ সালে স্থানীয় আলট্রা রাইট ন্যাশনালিষ্ট গ্রুপ OUN ও জার্মান ডেথ-স্কোয়াড Einsatzgruppen;এর সমন্বয়ে লবভ শহরে শুরু হয় Lviv pogroms (1941)। হাজার হাজার ইহুদিকে পৈশাচিক উন্মত্ততায় খুন করে এই মার্ডারাস সিন্ডিকেট।
১৯৪৫ সালে হিটলারের পতন হয়। পশ্চিম ইউক্রেইনের পুনর্দখল নেয় সোভিয়েতরা। স্থানীয় আলট্রা রাইট ন্যাশনালিষ্ট গ্রুপ OUN চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও স্বাধীন দেশ হিসাবে ইউক্রেইনের আত্মপ্রকাশের পর আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠে রক্ষণশীল ডানপন্থীরা। সাদা বর্ণবাদ মহামারীর মত ছড়িয়ে পরে ইউক্রেইনের পশ্চিম হতে। জালেনস্কি ও তার সরকার চোখ ফিরিয়ে নেয় নাৎসিবাদের উত্থান হতে।
ভাষাগত কিছু পার্থক্য থাকলেও আজকের ইউক্রেইন রাশিয়ারই প্রতিচ্ছবি। এক অর্থে ওরা মায়ের পেটের খালতো ভাই। অনেক কিছুর মত বর্ণবাদের প্রভাবও দুই দেশে প্রকট।
কেবল এই দুই দেশকে বর্ণবাদ রোগে চিহ্নিত করলে অসম্পূর্ণ হবে এই তালিকা। ,আজকের পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, চেক রিপাবলিক সহ প্রাক্তন সোভিয়েত বলয়ের প্রায় সব দেশ বর্ণবাদ রোগে আক্রান্ত। ঐ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের কাছে কালো আফ্রিকানরা হচ্ছে সাব-হিউমেন, ঈশ্বরের অপ-সৃষ্টি। নিজেদের চামড়ার রঙ নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় হতে ইনজেক্ট করা হয় চামড়ার এই বৈষম্য। তাই রুশ, ইউক্রেনিয়ান সহ ঐ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের রক্তে মিশে আছে অলিখিত, অঘোষিত ভয়াবহ এক রোগ, সাদা বর্ণবাদ। পশ্চিম ইউক্রেইনের অনেক অলিগলিতে এখনো ঘুরে বেড়ায় হিটলারের প্রেতাত্মা। বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেইনে ডি-নাজিফিকেশনের প্রবক্তা পুতিন নিজেও এই রোগে আক্রান্ত।