সোভিয়েত সাম্রাজ্য পতনের এপিটাফ তখনো লেখা হয়নি। বরং শুরু হয়েছে কেবল। চালকের আসনে বসে মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভ। লেনিন, স্তালিন, ক্রশেভ, ব্রেজনেভ, আন্দ্রোপভদের মত লৌহমানবদের লৌহশাসনের কঠিন বলয় গলতে শুরু করেছে কেবল। চারদিক পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্তের মৃদুমন্দ বাতাস।
সুযোগের সুবিধা নিয়ে প্রশ্নটা করে তাৎক্ষণিক ভাবে বুঝতে পারলাম উচিৎ হয়নি এমন কিছু করার। অথবা সোভিয়েত জনগণ এখনো তৈরি হয়নি এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার।
নিজদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্বের শেষ নেই রুশদের। বাকি বিশ্বের সবকিছু আন্ডার-মাইন করে নিজেদেরটা সেরা আখ্যা দেয়া রুশদের রক্তে। সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছিল রুশদের সাথে।
অনেকদিন ভেতরে আটকে রাখা প্রশ্নটা করতে বাধ্য হলাম:
'তোমরা যারা রুশ লেখক ও তাদের সাহিত্য কর্ম নিয়ে গর্ব কর তারা কি ভেবে দেখেছ গর্ব করার মত সবকিছুর সৃষ্টি ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের আগে? আলেকজান্ডার পুশকিন, লিও তলস্তয়, ফেওদর দস্তোয়াভস্কি, আন্তন চেখভের মত বিখ্যাত লেখকদের জন্ম সর্বহারাদের বিপ্লবের আগে? এমন একজন সোভিয়েত লেখক কি আছেন যার নাম তলস্তয় ক্যাটাগরিতে আনা যাবে?
আমার এমন প্রশ্ন নাকি সোভিয়েত ইন্টিগ্রেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠায় যা আইনের চোখে অপরাধ। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রশ্ন করার আগে নিজের পরিণতি নিয়ে চিন্তা করি, এমনটাই ছিল সাহিত্য বিশারদ রুশদের জবাব।
আজ ঘুম ভাঙ্গতে ইউটিউবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভলদিয়া (রুশ দেশে ভ্লাদিমিরের সংক্ষিপ্ত ভার্সন) পুতিনের এলোমেলো অথচ ইমোশনাল একটা ভাষণ শুনলাম। প্রায় প্রতিদিনই তিনি এমন ভাষণ দিচ্ছেন। জাতিকে বুঝাতে চাইছেন ইউক্রেইন আক্রমণের ঐতিহাসিক পটভূমি, এর প্রয়োজনীয়তা ও গতি প্রকৃতি।
'ক্যান্সেল কালচার' অর্থাৎ বাতিল সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। অভিযোগ করেছেন পশ্চিমা দেশগুলো রুশদের হিসাবের খাতা হতে মুছে ফেলেছে। বিশ্বখ্যাত রুশ মিউজিসিয়ান চাইকোভস্কি, রখমানিনভ, সেস্তাকোভিচদের সৃষ্টিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। প্রাসঙ্গিক-ভাবে তুলে এনেছেন হ্যারি পোর্টার লেখক জে কে রোলিং'এর নাম। জেন্ডার ডিমান্ড মিট করতে না পারায় ঐ লেখককে যেমন বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছিল, তেমনি নাকি রুশদের সাহিত্য কর্মও নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
এক কালের পরাশক্তি রাশিয়া কোন মানদণ্ডেই এখন আগের অবস্থানে নেই। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অস্ত গেছে সেই ১৯৯১ সালে। রুশদের ছেড়ে চলে গেছে ১৯১৭ সালে বলশেভিকদের তরবারির ঝলকের কাছে হার মানা বাকি চৌদ্দটি প্রজাতন্ত্র। ভালমন্দ মিলিয়ে ওরা চেষ্টা করছে নিজেদের মত বেঁচে থাকতে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে অনেকে যোগ দিয়েছে ন্যাটো জোটে। ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হতে অনেকে সদস্য হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর কায়দায় গড়ে উঠা ওয়ারশ জোটের হেডকোয়ার্টার খোদ ওয়ারশ এখন ন্যাটো বাহিনীর দুর্গ।
এসব রুশ সমর শক্তি অথবা সাহিত্য সংস্কৃতি বাতিলের অংশ নয়। বরং জাতি হিসাবে প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলো বেঁচে থাকার লড়াই মাত্র।
পুতিন ও তার ক্রেমলিন চক্র হয়ত ভুলে গেছে রুশদের সোভিয়েত সাম্রাজ্য এখন ইতিহাস। সমাহিত ঐ ইতিহাসে বাতিল করার মত কোন সংস্কৃতি নেই। বন্দুকের নলের মুখে এমন কোন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়নি যা বাকি বিশ্বকে বাতিল করতে হবে। তলস্তয়, চেখভ, রখমানিনভরা সোভিয়েত সাম্রাজ্যের প্রোডাক্ট নয় যা নিয়ে পুতিনের মত একনায়কদের হা হুতাশ করতে হবে। ওদের সাহিত্য কর্ম বেঁচে আছে বেঁচে থাকবে যতদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে।
পশ্চিমাদের বাতিল সংস্কৃতির জবাব দিতেই কি তাহলে ইউক্রেইন আক্রমণ? পুতিনের আবেগি ভাষণ শুনে আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ঝিকে পিটিয়ে বৌকে শেখানোই ছিল ইউক্রেইন আক্রমণের আসল উদ্দেশ্য। ১ কোটি মানুষকে বাড়িছাড়া বানিয়ে ম্যাসেজ দিচ্ছে তোমরা তলস্তয় চাইকোভকস্কিকে ভুলতে পারবেনা। ভুলতে চাইলে এমনটাই হবে তোমাদের পরিণতি!