স্বৈরশাসক পুতিন ও তার সেনাবাহিনীর মহিমা নিয়ে বাংলাদেশিদের অন্যরকম আচ্ছন্নতা আছে। হোক তা স্বদেশে অথবা বিদেশে। সামাজিক মাধ্যমে হাজার হাজার বাংলাদেশি পুতিনের ইউক্রেইন আক্রমণের পক্ষে সাফাই গাইছে। সাফাই গাইছে এই ছুতায়,, আমেরিকা নাকি তাদের দুয়ারে এসে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনী করছে। নিজেদের অস্তিত্বের কারণকেই নাকি এই আক্রমণ দরকার ছিল। অন্যদিকে খোদ পুতিন গোড়াতে এই আক্রমণের কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন পৃথিবীর মাটি হতে নব্য নাৎসিদের নির্মূল করা। প্রায় দেড় বছর আগে শুরু করা যুদ্ধের এক পর্যায়ে রুশ প্রেসিডেন্ট সরে আসেন নিজের অবস্থান হতে। নাৎসি নির্মূল বিদায় দিয়ে হাজির করেন হারিয়ে যাওয়া রুশ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার তাগাদা।
যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহের ভেতর কিয়েভের ব্যস্ত রেস্তোরায় ভদকা পান করার রুশ জেনারেলদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা মাঠেই মারা যায়। এবং এ মুহূর্তে পুতিন যুদ্ধ নিয়ে অনেকটাই নীরব। আগের মত আর হম্বি তম্বি করে রুশ ভদকা ঐতিহ্যের মহিমা ফিরিয়ে আনার দাবি করেন না।
তবে দাবি নিয়ে মাঠ গরম করছেন অন্য একজন। তিনি হচ্ছেন এক কালের পুতিনের পাচক, রেঁস্তোরা ব্যবসায়ী ও সমসাময়িক কালের রুশ
ভাড়াটিয়া বাহিনী ভাগনারের প্রধান ইভগেনি প্রিগোঝিন (Евге́ний Ви́кторович Приго́жин)।
যাদের জানা নেই কে এই প্রিগোঝিন ও ইউক্রেইন যুদ্ধে কি ভূমিকা রাখছে তার Wangner বাহিনী তাদের জন্যে কিছু তথ্য।
১৯৬১ সালে জন্ম প্রিগোঝিনের। সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্ম নিয়ে ওখানেই বেড়ে উঠেন। হরেক রকম ক্রাইমের সাথে জড়িত হয়ে লতায় পাতায় একজন পাক্কা অপরাধী হিসাবে বেড়ে উঠেন। ১৯৭৯ সালে চুরি ও ১৯৮১ সালে ডাকাতির দায়ে জেল খাটেন।
জেল হতে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় জড়িয়ে চালু করেন জনপ্রিয় ভাসমান রেস্টুরেন্ট নিউ আইল্যান্ড। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উত্থান ঘটান দেশটার জন্যে একেবারেই নতুন এক ব্যবসা, ক্যাসিনো।
ভাগ্যচক্রে একই সময় ভ্লাদিমির পুতিন নিয়োজিত হন গ্যাম্বলিং ও জুয়া এডভভ্যাইজরি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে। বলাহয় ওখানেই পরিচয় দুজনের। এরপর আর প্রগোঝিনকে পিছু তাকাতে হয়নি।
আর দশটা একনায়কতান্ত্রিক দেশের মত রাশিয়াও শাসকদের ছত্রছায়ায় প্রিগোঝিন বদলে ফেলেন নিজের ভাগ্য। স্রোতের মত আসতে শুরু করে বিত্ত বৈভব।
বুদ্ধিমান প্রিগোঝিন নিজের ভাগ্য চাকা ঘুরাতে নতুন এক পথ আবিষ্কার করেন। বলা হয় তাতেও হাত ছিল ক্রেমলিনের।
২০১৪ সালে গড় তুলেন ভাড়াটিয়া সৈন্যবাহিনী ভাগনার। ঐ একই সালে পুতিনে ইউক্রেইনের ক্রাইমিয়া অভিযানের মূল শক্তি ছিল এই প্রাইভেট বাহিনী। পরবর্তীতে এই বাহিনী পৃথিবীর দেশে দেশে ভাড়া খাটতে শুরু করে। খুব দ্রুতই নির্মমতার জন্যে বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকদের প্রিয় হয়ে উঠে। সুদূর লিবিয়াতেও বর্বরতার জন্যে কুখ্যাতি লাভ করে। ওয়াগনার বাহিনী সিরিয়ায় স্বৈরশাসক বশীর আল আসাদের হয়ে ফসফরাস বোমা মেরে খুন করে শত শত সিরিয়ান যারা আসাদের একনায়কতান্ত্রিক সরকার হতে মুক্তি পাওয়ার লড়াই করেছিল।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশদের ইউক্রেইন অভিযানের অনেক আগেই অগ্রবর্তী দল হিসাবে ওয়াগনার বাহিনী দনবাস এলাকায় নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছিল। এ বছরের শুরুতে লো মোরাল রুশ বাহিনীতে দেখা দেয় জন সংকট। পুতিন হাত বাড়ান তার পার্টনার ইন ক্রাইম প্রিগোঝিনের দিকে। প্রিগোঝিন লুফে এ প্রস্তাব।
সেনাবাহিনীতে যোগদানে পুতিনের ম্যান্ডেটরি ড্রাফট হতে বাঁচার জন্যে কয়েক লাখ রুশ তরুণ পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশগুলোতে।
ফ্রন্টে নিহত ও আহত সৈন্যদের মিছিল লম্বা হওয়ার কারণে রুশরা এড়িয়ে যেতে শুরু করে পুতিনের দেশপ্রেমের ডাক।
আইডিয়াটার জন্ম প্রিগোঝিনের মগজে। সৈন্য যোগাতে তার জন্যে খুলে দেয়া হয় রুশ দেশের জেলখানা। অসময়ে মুক্তির লোভ দেখিয়ে কনভিক্ট ক্রিমিনালদের ভেড়াতে শুরু করে তার বাহিনীতে। ফল পেতেও খুব একটা সময় লাগেনি।
ভাগনার বাহিনীর সাফল্যে টনক নড়ে রুশ জেনারেলদের। দেশটার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই সইগো ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেন। পুতিনের কাছে নিজদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ভাগনার বাহিনীর সাপ্লাই চেইনে সমস্যা শুরু করেন। অস্ত্র ও গোলাবারুদ সময় মত ফ্রন্টে না আসায় ভাগনার বাহিনী নাস্তানাবুদ হতে শুরু করে ইউক্রেনিয়ানদের হাতে। নিজ বাহিনীর সেনাদের লাশের পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রিগোঝিন হুমকি দেয়া শুরু করে পুতিন প্রশাসনকে।
আজ এক বিস্ফোরক ভিডিও বার্তায় প্রিগোঝিন অভিযোগ এনেছেন রুশ সেনাবাহিনী নাকি ইউক্রেইন ফ্রন্টে তার নিজ বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করেছে। একই বার্তায় তিনি কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেন চরম প্রতিশোধের। আহবান জানিয়েছেন সামরিক অভ্যুত্থানের।
পাশাপাশি ঘোষণা দিয়েছেন তার বাহিনীর অনেকে ইউক্রেইন ফ্রন্ট ত্যাগ করে রাশিয়ায় ফিরে যাচ্ছে। একদিকে রুশ বাহিনী অন্যদিকে ইউক্রেইন বাহিনীর পালটা আক্রমণের ফলে দিশেহারা ভাগনার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
প্রিগোঝিন এই প্রথম জনসম্মুখে প্রকাশ করছেন রুশদের ইউক্রেইন আক্রমণের আসল উদ্দেশ্য। উড়িয়ে দিয়েছেন নাৎসি নির্মূল সহ রুশ ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের দাবি। তার মতে সেইগো-গেরাসিমভ চক্র নিজেদের গদি পোক্ত ও লেগাসি মহিমান্বিত করার জন্যে পুতিনকে ভুল তথ্য দিয়ে যুদ্ধে নামিয়েছে।
নিজ বাহিনীর উপর রুশ সেনাবাহিনীর হামলা পাল্টা অক্রমণের মাধ্যমে দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার কঠিন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ইবগেনেই প্রিগোঝিন।
অনেকে ক্রেমলিনে সামরিক অভ্যুত্থানের আশংকা প্রকাশ করছে। ব্যবস্থা নিতে ক্রেমলিনে দফায় দফায় মিটিং করছেন পুতিন।
সামরিক বিশারদদের মতে ইউক্রেইন সেনাবাহিনীর বহু প্রতীক্ষিত পালটা আক্রমণের ফল হচ্ছে এই আভ্যন্তরীণ কোন্দল। গেল কয়েক মাস ধরে পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন প্রশাসন এতদিন আটকে রাখা বিধ্বংসী ট্যাংক সহ অনেক গোলাবারুদ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইউক্রেইন সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে ন্যাটো জেনারেলরা। রুশদের প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ড ন্যটোতে যোগদানের ফলে দেড় হাজার কিলোমিটারের নতুন ফ্রন্ট উন্মুক্ত হয়েছে। এখন দেখার বিষয় পুতিন কোন শক্তি দিয়ে ফিনল্যান্ডকে শায়েস্তা করেন।
রুশরা সমসাময়িক বিশ্বে কোন পরাশক্তি নয়, এ বাস্তবতা তারা যত দ্রুত মেনে নেবে তত দ্রুতই মঙ্গল হবে মানব সভ্যতার। ইউরোপ আজ কেবল একটা মহাদেশ নয়, বরং একটা পরিবার। এই পরিবারে যোগদানের মধ্য দিয়েই রুশরা স্বাদ নিতে পারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন। তবে তার জন্যে চাই একনায়ক-তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হতে বেরিয়ে গণতন্ত্রের পথে পা রাখা। শুরটা হতে পারে পুতিনকে এলিমিশনের মাধ্যমে!