শ্রুতিমধুর এই শ্লোগান দাবানলের মত ছড়িয়ে পরছে বিশ্বের এক প্রান্ত হতে প্রান্তে। গতকাল লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ সহ ইউরোপের অনেক দেশের রাজধানী সাক্ষী হয়েছে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে উত্তাল প্রতিবাদের। এবং এ প্রতিবাদ ছড়িয়ে পরছে দক্ষিণ আমেরিকা হতে শুরু করে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত।
শুনতে আর দশটা শ্লোগানের মত শোনালেও 'ফ্রম দ্যা রিভার টু দ্যা সী' শ্লোগানের আলাদা একটা অর্থ আছে, যার মর্ম উদ্ধার করতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইসরায়েল নামের দেশ ও তার দখল করা গাজা উপত্যকা সহ অবরুদ্ধ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন অঞ্চলের ম্যাপের দিকে।
জর্ডান নদী হতে শুরু করে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত ফিলিস্তিন মুক্ত করার অর্থ একটাই, ইসরায়েল নামের দেশটার অস্তিত্বকে মুছে ফেলা। আর এ জন্যেই এ ধরণের একটা শ্লোগান ইসরায়েল প্রেমীদের মনে আগুনের গোলার মত আঘাত হানে।
ইসরায়েল নামের দেশটার অস্তিত্ব একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এ বাস্তবতায় ঋষি সুনাকের ব্রিটেন, ওলাফ স্কলজের জার্মানি, গিওরর্গিয়া মেলোনি'র ইতালি সহ এশিয়ার জাপানেরও ভূমিকা আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনীর হাতে ৬০ লাখ ইহুদি প্রাণ হারিয়েছিল। এই যুদ্ধে জার্মানদের সহযোগী ছিল ইতালি ও জাপান। একই যুদ্ধে হিটলার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হতে বিতাড়িত ইহুদিদের নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে না নিয়ে এই ধর্মাবলম্বীদের জন্যে পৃথক একটা দেশ প্রতিষ্ঠার তাগাদা অনুভব করে যুদ্ধজয়ী মিত্র বাহিনী।
এক সময় ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইন অঞ্চল ছিল ব্রিটিশদের দখলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পরলে ঐ অঞ্চলে তাদের অবস্থানও দুর্বল হয়ে পরে। কলোনিয়াল বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরে তারা প্যালেস্টাইনকে তুলে দেয় ব্রিটিশদের হাতে। এই ব্রিটিশরাই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্যে প্যালেস্টাইন অঞ্চলের নাম প্রস্তাব করে। অজুহাত হিসাবে তুলে ধরে হাজার বছর আগে ঐ অঞ্চলে ইহুদিদের রাজত্ব।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে এবং তার তত্ত্বাবধানে ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে অভ্যুদয় ঘটে ইসরায়েল নামক ইহুদি রাষ্ট্রের। এই রাষ্ট্রের সীমানায় পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। মধ্যপ্রাচ্যের এসব অঞ্চল তখন ছিল যথাক্রমে জর্ডান ও মিশরীয়দের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার ত্রিমুখী ইসরায়েল আক্রমণে বদলে যায় ইসরায়েলের মানচিত্র। এই তিন আরব দেশ ৬ দিনের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং হারায় জেরুজালেম, পশ্চিম তীর সহ গাজার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ। উত্থান ঘটে নতুন ইসরায়েলের।
আজকের ইসরায়েল পারমানবিক শক্তি সম্পন্ন একটি দেশ। দেশটার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ যোগায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর পেছনেও আছে অন্য এক সমীকরণ। মানবতা ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা এই দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির আসনে বসে আছে দেশটার ইহুদি জন-গুষ্টি। এই শক্তিই নিয়ন্ত্রণ করে কে হবে এই দেশের প্রেসিডেন্ট, কে বসবে কংগ্রেস সীটে। কংগ্রেসের প্রতিটা আসনে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবে এমন প্রার্থীর পেছনে ব্যয় করে অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ। এসব সদস্য নির্বাচিত হয়ে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা না করলে পরের নির্বাচনে বিদায় নিতে হয়। ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সরকারের অন্ধ সমর্থনের পেছনে আছে এই এক কারণ। হয় ইসরায়েলকে সমর্থন দাও, নইলে মার্কিন শাসন ব্যবস্থার যে কোন পর্যায় হতে বিদায় নাও। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনও এর বাইরে নন। ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্ত মার্কিন শাসন ব্যবস্থায় কোন ফ্যাক্টর না, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা হচ্ছে আসল ফ্যাক্টর। তারই অংশ হিসাবে যুদ্ধের প্রথম প্রহরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দৌড়ে গেছেন ইসরায়েলে। দেশটার রক্ত পিপাসু প্রধানমন্ত্রী নেতনিয়াহুর সাথে ফটো সেশন করে নিজ দেশের ইহুদি লবিদের নিশ্চিত করেছেন তার ইসরায়েল প্রীতি। আর এই নিশ্চয়তাই বাইডেনের জন্য নিশ্চিত করবে ইহুদি লবির মিলিয়ন মিলিয়ন নির্বাচনী ফান্ড।
ফিলিস্তিন সমস্যার সত্যিকার সমাধান চাইলে মুসলিম বিশ্বকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বাস্তবতা। জিহাদি যোশে বলিয়ান হয়ে এই দেশটার অস্তিত্ব বিলীন করার মনমানষিকতা ত্যাগ না করলে যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি অব্যাহত থাকবে।
ইসরায়েলের পাশাপাশি প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের বাস্তবতাও জাতিসংঘের সনদের মাধ্যমে নিশ্চিত করা আছে। যতদিন দুই রাষ্ট্রের বাস্তবতা ইসরায়েল অথবা হামাসের মত রাজনৈতিক শক্তি অস্বীকার করতে থাকবে ততদিন ঝড়তে থাকবে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের রক্ত। এ রক্ত নদী পার হয়ে এক সময়ে সাগরে ঠাঁই নেবে আর আমরা অসহায়ের মত দেখতে থাকবো রাষ্ট্র ইসরায়েল ও হামাসের পশুত্ব।