সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একদলীয় তথা একব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের শক্ত অবস্থানের মূলে আছে পৃথিবীর দেশে দেশে মানবতা ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখায় দেশটার প্রতিশ্রুতি। অন্তত এমনটাই বলে থাকে দেশটার পলিটিকাল প্রোপাগান্ডা মেশিন।
দেড় বছর আগে শুরু হওয়া রুশদের ইউক্রেইন আক্রমণে ইউক্রেনিয়ানদের পক্ষ নেয়ার কারণও জাস্টিফাই করা হয়েছিল একই কারণ দেখিয়ে। ইউটিউব ঘাঁটলে এখনও পাওয়া যাবে মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি এন্থনী ব্লিনকিনের আবেগময়ী ভাষন, যেখানে তিনি কঠিন ভাষায় সমালোচনা করছেন ইউক্রেইনের বেসিক নেসেসিটির ইনফ্রাষ্ট্রাকচারে রুশদের আক্রমণ। বিদ্যুৎ ও পানি বিচ্ছিন্ন করা, আহতদের চিকিৎসা সেবা হতে বঞ্চিত করাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
একই ব্লিনকেন আজ আন্ধা, বোবা ও কালা গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ম্যাসাকার নিয়ে। ২০ লাখ মানুষকে পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য, চিকিৎসা হতে বঞ্চিত করে বাড়ি-ঘর, স্কুল, হাসপাতাল বোমা মেরে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে দখলদার ইসরায়েল বাহিনী। যুদ্ধ বন্ধ দূরে থাক, বিরতিতেও সন্মতি নেই ব্লিনকেন তথা মার্কিন সরকারের। এ ধরনের বিরতি নাকি হামাসকে সাহায্য করবে। ওরা রি-গ্রুপিং করে আবারও ফিরে আসবে এমনটা আশংকা। আবারও আক্রমণ করবে ইসরায়েলকে।
গাজায় প্রতি দশ মিনিটে একজন করে শিশু খুন হচ্ছে। প্রশ্ন করলে ব্লিনকেন বাহিনীর উত্তর হচ্ছে, হাসপাতালের নীচে নাকি হামাস বাহিনী লুকিয়ে আছে, তাই ঐ হাসপাতাল গুড়িয়ে দেয়ায় ইসরায়েলের অধিকার আছে। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নির্বাচনের বিতর্কে প্রায় সব প্রার্থী একবাক্যে আহবান জানিয়েছেন ইসরায়েলের গাজা মিশন শেষ করে আসার জন্যে।
বেশিদূরে যাওয়ার দরকার নেই, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবতা সমুন্নত রাখায় নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা বার বায় ব্যক্ত করছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। পদক্ষেপ হিসাবে বাংলাদেশের ভোটচোর সরকারকে প্রায় একঘরে করে ফেলেছে।
এখানেই আসে প্রশ্নটা; ইউক্রেইন ও বাংলাদেশের বেলায় যা প্রযোজ্য ইসরায়েলের বেলায় কেন তা নয়। কি এর রহস্য? কোথায় এর গোঁড়া?
বাজে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করবো নিজের জ্ঞান। ২৩ বছর দেশটায় বাস করে অনেক কিছুই শিখেছি ও বুঝেছি এবং ইসরায়েলের বেলায় মার্কিন হিপোক্রেসির পক্ষে নিজের উপসংহার টানতে সক্ষম হয়েছি।
ধরে নেই প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দখল করে ওখানে গণহত্যা চালাচ্ছে। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ অথবা সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের কেউ একজন দেশটার সরকার প্রধান।
আওয়ামী লীগ ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, মুখ খুলে সমালোচনাও করবেনা। কারণ একটাই ক্ষমতা। সংখ্যালঘু প্রধানমন্ত্রীর কারণ হবে আরও নেকেড। কারণ তার কাছে ভারত হচ্ছে তার আদি ও আসল বাসস্থান। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সাগরের সাথে মিশিয়ে দিলেও তিনি টু শব্দটি করবেন না। কারণ ধর্মীয় ও ক্রিটিক্যাল সময়ে সেইফ হেভেন হিসাবে ব্যবহার করার নিশ্চয়তা।
এবার আসুন মার্কিনীদের দিকে চোখ ফেরাই।
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়া অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা মেল গিবসন মাতাল অবস্থায় ক্যালিফোর্নিয়ার মালিবুতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পুলিশ তাকে থামায় এবং বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। যে পুলিশ তাকে থামায় সে ছিল ইহুদি ধর্মাবলম্বী। ঘরে ফিরে গিবসন তার বান্ধবীকে মারধর করে এবং একই সময় ইহুদিদের নিয়ে খিস্তি-খেউর করে। পরে তার বান্ধবী পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গিয়ে গিবসনের এন্টি-ইহুদি অবস্থানের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এবং বলতে গেলে এখানেই শেষ হয় প্রতিভাবান এই অভিনেতার অভিনয় ক্যারিয়ার। হলিউডের কোন প্রযোজক পরিচালক এই অভিনেতাকে তাদের ছবিতে কাস্ট করতে অস্বীকার করতে শুরু করে। স্থানীয় প্রচার মাধ্যম দিনের পর দিন গিবসনের ইহুদি বিরোধী মনোভাব নিয়ে হরেক রকম কাহিনী প্রচার করতে থাকে। এ নিয়ে কংগ্রেসেও কথা হয়। ঐ ঘটনার পর মেল গিবসন মনে রাখার মত কোন ছবিতে অভিনয় করেছেন বলে শোনা যায়নি।
একই গিবসন যদি মুসলমানদের নিয়ে একই ধরণের কথা বলতো তাহলে কি তার বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নিতো? বিশেষ করে অভিনয় ব্যবসায়?
এই একটা উদাহরণ দিয়েই আমেরিকানদের ইসরায়েল প্রীতির সমীকরণ টানা যায়।
হলিউড চলে ইহুদিদের অর্থে। এখানে যারা টাকা খাটায় তাদের অধিকাংশই এই ধর্মের।
আমেরিকান রাজনীতিতে ইহুদি প্রভাব আরও গভীর আরও সুদূরপ্রসারী।
এ দেশের প্রতিটা নির্বাচনে ইহুদি গুষ্টি বড় ধরনের বিনিয়োগ করে থাকে। নির্বাচিত হয়ে যারা ইসরায়েলের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে কেবল তাদের পেছনেই বিনিয়োগ করে থাকে এই গুষ্টি। এবং তাদের অর্থ বায় করেই নির্বাচিত হয় দেশটার প্রেসিডেন্ট হতে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের কাউন্সিলর পর্যন্ত।
হামাস ইসরায়েল যুদ্ধের প্রথম প্রহরে বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট বাইডেন কেন ইসরায়েল উড়ে গিয়ে নিজ সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তার পেছেনেও আছে ইহুদি অর্থ। এমনিতেই তার অবস্থান খুবই নড়বড়ে, সামনের নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তার উপর দেশটার ইহুদি লবি যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাকে গো হারা হারতে হবে, এমনটা আন্দাজ করেই দৌড়ে গিয়েছিলেন মার্কিন নির্বাচনের আসল মালিকদের দুয়ারে।
মার্কিন অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ইহুদি মানি। আর এই ইহুদিরা নিজেদেরর প্রমিস ল্যান্ডের জন্যে এমন কোন কাজ নেই যা করবেনা। গাজায় দশ মিনিটে ১টা কেন, এক হাজার শিশুকে খুন করলেও ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের সামান্যতম হেরফের হবেনা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা হিন্দুদের প্রমিস ল্যান্ড যেমন ভারত, তেমনি ইহুদিদের প্রমিস ল্যান্ডও ইসরায়েল। হিন্দুদের পবিত্র দায়িত্বের একটা হচ্ছে ভারতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, ইসরায়েলের বেলায় একই দায়িত্ব ইহুদিদেরও। ফিলিস্তিনিদের জন্যে সমস্যা হচ্ছে উন্নত বিশ্বের ইহুদি মানি ও লবি ধীরে ধীরে ক্রয় করে নিচ্ছে কথিত মুসলিম বিশ্বের অবস্থাপন্ন অংশকে।