মার্কিন নিউজ মিডিয়া গেল দুই সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিকভাবে হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের উপর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সিএনএন ও এমএসএনবিসি তাদের নিয়মিত প্রচার বন্ধ করে ইসরায়েল এট ওয়ার শিরোনামে একতরফা ভাবে এই কনফ্লিক্টের একদিক প্রচার করে যাচ্ছে।
সিএনএন'এর অ্যান্ডারসন কুপার সহ আরও কজন নিউজ এংকর এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে অবস্থা করছেন। যে সীমান্ত দিয়ে হামাস ইসরায়েলে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালিয়েছিল সে এলাকার ভুক্তভোগী মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিরামহীন ফিচার উপস্থাপন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি গাজায় ইসরায়েলের স্মরণকালের বরবর্বতম আক্রমণ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
' Israel has right to defend himself' এই ধুয়া তুলে প্রকারান্তে জাষ্টিফাই করে যাচ্ছে গাজার শত শত শিশুর হত্যাকাণ্ড।
দেশটার দুই দলীয় রাজনীতির প্রায় সবাই ইসরায়েলের চাইতে বেশি ইসরায়েলি সেজে এমন একটা চিত্র আঁকার চেষ্টা করছেন যা আমলে নিলে মনে হবে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যার শুরু ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর, যেদিন হামাস তার আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। আসলেই কি তাই?
আমেরিকান জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশই জানেনা এই কনফ্লিক্টের ইতিবৃত্ত। জানেনা ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাৎসি বাহিনীর হাতে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডে ফিলিস্তিনিদের কোন হাত ছিলনা। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপীয়রা ইহুদি জন-গুষ্টির সাথে যে অন্যায় করেছিল তার মূল্য নিজেরা পরিশোধ না করে তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল প্যালেস্টাইন জন-গুষ্টির উপর।
হ্যাঁ, ১৯৪৭ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্মের আগে প্যালেস্টাইন নামের কোন দেশের অস্তিত্ব ছিলনা। কিন্তু ইতিহাস বলে প্যালেষ্টাইনি বাস্তবতার শিকড় ঐ অঞ্চলে ইহুদি রাজত্বের এক হাজার বছরেরও পুরানো।
পর্যায়ক্রমে প্যালেস্টাইনকে শাসন করে গেছে আসিরিয়ানরা, ব্যাবিলিয়ানরা, পার্সিয়ানরা, গ্রীকরা, রোমানরা, তুর্করা, ক্রুসেডর ও জর্ডানিয়ানরা সহ আরও অনেকে।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পরলে প্যালেস্টাইন অঞ্চলের দখল চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জার্মানি সহ ইউরোপের শিল্পোন্নত অনেক দেশে ইহুদিরা সমস্যা হয়ে দেখা দেয় অর্থনীতির উপর এই জন-গুষ্টির নিয়ন্ত্রণের জন্যে। অস্ট্রিয়ার নাগরিক এডলফ হিটলার এই ন্যারেটিভকে কাজে লাগিয়েই প্রতিবেশী জার্মানিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এই ক্ষমতায়নের ফলই ছিল হলোকষ্ট, যা কেড়ে নিয়েছিল ৬০ লাখ ইহুদির প্রাণ। একটা আলাদা ইহুদি-ভূমির তাগাদার শুরুটা ছিল এই হত্যাকাণ্ডের সূতিকাগারে।
ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব কলোনি প্যালেস্টাইনকে তুলে দিয়েছিল লীগ অব নেশনস'এর হাতে। ইউরোপিয়ান ও জাতিসংঘের যৌথ প্রযোজনায় ১৪ই মে, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের ইসরাইল।
জাতিসংঘের ম্যাণ্ডেট ইসরাইলী যে সীমানার বৈধতা দিয়েছিল তা বদলে যায় ১৯৬৭ সালে ৬ দিন স্থায়ী আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর। একদিকে মিশরের সানাই প্যানিনসুয়েলা ও গাজা স্ট্রিপ, জর্ডানিয়ানদের জেরুজালেম সহ পশ্চিম তীর ও সিরিয়ার গোলান হাইটস দখলে নিয়ে নিজেদের বলে দাবি করতে শুরু করে ইসরাইল। যদিও পরে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিশর ফিরে পায় তার সানাই।
এক অর্থে ইসরাইল-প্যালেস্টাইন কনফ্লিক্টের শুরু সেই সময় হতে। ৭ই অক্টোবর হামাসের আক্রমণ ছিল তার ধারাবাহিকতা মাত্র। গাজাকে বলা হয় পৃথিবীর ভয়াবহতম ওপেন এয়ার প্রিজন। এই জেলখানায় গেল ৪৬ বছর ধরে ২২ লাখ প্যালেষ্টাইনিদের আটকে রেখে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করছে দখলদাররা। অন্যদিকে প্রায় ৩৪ লাখ প্যালেষ্টাইনিকে তাদের বাড়িঘর হতে উচ্ছেদ করেছে ইসরাইয়েলিরা, যারা আজকে শরণার্থী হিসাবে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া সহ আরও অনেক দেশে বাস করছে।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সমস্যার শিকড় অনেক গভীর যা ইচ্ছাকৃত-ভাবে মার্কিন জনগণকে জানতে দেয়া হচ্ছেনা। তার মূলেও আছে দেশটায় বসবাসরত শক্তিশালী ইহুদি লবি। মার্কিন মিডিয়ার প্রায় সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই লবি। এদের অর্থেই নির্বাচিত হয় দেশটার প্রেসিডেন্ট সহ কংগ্রেস সদস্যারা। ইসরাইল আক্রান্ত হওয়ার ঊষালগ্নে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কেন ঐ দেশে সফরে গেলেন তার মূলেও আছে ইহুদি লবির সমর্থন ও তাদের অর্থ। সামনের নির্বাচনে জিতে হোয়াইট হাউসে টিকে থাকতে চাইলে এই লবিকে সন্তুষ্ট করেই টিকে থাকতে হবে।
অনেকের জন্যে এ এক বিশাল ধাঁধা, কেন আমেরিকা ইসরাইলের এত অন্ধ সমর্থক? উত্তর একটাই, ইহুদি লবির অর্থ ও তাদের অর্থে গড়ে উঠা বিশাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক।