মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হতে উঠে আসা বাংলাদেশের ছাত্রদের সত্যিকার ছাত্রজীবন শুরু হয় যখন তারা পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় পা রাখে উচ্চশিক্ষার জন্যে। উন্নত বিশ্বে ১৮ বছর বয়সটা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মাইলষ্টোন হিসাবে কাজ করে, আমাদের দেশে বয়স বরং কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পনই এ ধরনের স্বাধীনতার দিগন্তরেখা উন্মোচন করে দেয়। শিক্ষিত, আধাশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মা-বাবার হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের পয়সায় লালিত সদ্য যৌবন প্রাপ্ত কিশোর ক্যাম্পাসে পা রেখেই রাতারাতি বনে যায় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি, সমাজনীতি সহ যাবতীয় নীতির ধারক, বাহক, পন্ডিত এবং রক্ষক। যে শিশু অর্থনীতির ধারাপাত খুলে দেখার সময় পায়নি, যাকে দিন, সপ্তাহ এবং মাস শেষে হা হয়ে তাকিয়ে হয় মা-বাবার পকেটের দিকে, সে শিশু বনে যায় ইতিহাস পন্ডিত। মুজিব এবং জিয়া নিয়ে বাংলাদেশের চিরন্তন লড়াইয়ের একধারে সে হয়ে যায় বাদি, বিবাদী এবং বিচারক। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই অপশিক্ষা এবং অন্ধ বিশ্বাষের জড়ায়ুতেই জন্ম নেয় ভবিষৎ রাজনীতির কর সেবক, যাদের অস্থিত্ব শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ভূলুণ্ঠিত করে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষৎ।
আমাদের উচ্চ শিক্ষার কাঠামো এখনো অবিভক্ত ভারতের বৃটিশ ভূত রাজত্ব করছে, তার সাথে যোগ হয়েছে রাজনীতি নামের ক্ষয়িষু-ব্যাধি। আমাদের অনুৎপাদনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজের সমাসাময়িক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ যার প্রতিফলন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। ইসলামের ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এ সবের মত অপ্রয়োজনীয় এবং দেউলিয়া বিষয়ের উপর লাখ লাখ ছাত্র লেখাপড়ার করছে, মা-বাবার কষ্টের পয়সায় আয়েশি এবং সন্ত্রাষী জীবন কাটিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে ঘরে ফিরে, নাম লেখায় চীর বেকারত্বে। যে উচ্চশিক্ষা দরিদ্র পরিবারের দারিদ্র দূর করার কথা, সে শিক্ষা পরিবারের জন্যে নিয়ে আসে নতুন দারিদ্র, মানষিক বিকলাংগতা। ডিগ্রীধারী এবং রাজনৈতিক অপশিক্ষায় দিক্ষিত অসূস্থ সেনারা না পারে শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে, না তাদের ডিগ্রী কাজে আসে প্রতিযোগীতাপূর্ণ চাকরীর বাজারে। স্বভাবতই তাদের জন্যে খোলা থাকে দু’টো রাস্তা; এক, রাজনীতিকে পূজি করে ভাগ্য সন্ধানের চেষ্টা; দুই, বসত বাড়ি বিক্রী করে বিদেশ পাড়ি জমানো। পরিনতিতে জন্ম নেয় নতুন এক প্রজন্ম; ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক ভৃত্য। এ সব ভৃত্যদের কাধে ভর করে উত্থান হয়ে লালু-ফালুদের সাম্রাজ্য। মা-বাব সহ পরিবারের সবাইকে পথে বসিয়ে যারা বিদেশ পাড়ি জমায়, কিছুদিন না যেতেই তাদের ঝোলা হতে বেরিয়ে পরে সেই রাজনৈতিক ব্যাধি। এ এক গোলক ধাঁধাঁ। যেখানেই বাংলাদেশী সেখানেই রাজনীতি, এবং সেখানেই আক্রমন, পাল্টা আক্রমন, হুমকি-ধামকি, ব্যক্তি পূজা, পরিবার পূজা। অথচ রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য হওয়ার কথা দেশের ভাল মন্দ, কিন্তূ কোথায় তা?
উচ্চবিত্ত এবং স্বীকৃত রাজনীতিবিদ্দের সন্তানদের ক’জন দেশে লেখাপড়া করছে? করলেও কোথায় এবং কেন করছে এর উত্তত খুজতে গেলে বেরিয়ে আসবে আজব এক চিত্র! এদের অধিকাংশই বিদেশে পাড়ি জমায় অল্প বয়সে, ঢাকা অথবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও তাদের দেখা নেই, তাদের জন্যে এসব জায়গা অস্পৃশ্য এবং নিষিদ্ব।
এসব সহজ সরল সমীকরন গুলো বুঝতে ডঃ ইউনুস হওয়ার প্রয়োজন পরেনা, ব্যক্তিপূজার নেশা হতে মুক্তি নিয়ে উন্মুক্ত বিশ্বের দিকে চোখ তুলে তাকালেই পরিস্কার হয়ে যাবে জাতি হিসাবে আমাদের অবস্থান। আজকের দুনিয়ায় আমরা কেউ নই, আমাদের পরিচয় মানবতার উচ্ছিষ্ট এবং আবর্জনা হিসাবে। এবং এর সবটুকু দায়-দায়িত্ববর্তাতে বাধ্য রাজনীতিবিদ্দের উপর।
এক কদম আগে, দু’কদম পেছনে।