মেরুকরনের অক্টোপাস হতে বাংলাদেশে মৃত্যুও বোধহয় মুক্ত নয়। বেচে থাকতে যেমন চাই পায়ের নীচে মেরুর শক্ত মাটি তেমনি মরণেও মেরুর দাপট একজন বাংলাদেশীকে তাড়িয়ে নেয় কবর পর্য্যন্ত। এখানে মানুষের জন্মমৃত্যু শুধু মানুষ হিসাবেই নয় তার সাথে থাকা চাই তার দলীয় এবং আদর্শগত পরিচয়, এবং তখনই কেবল সে পূর্ণাংগ মানুষ।
অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে বিডিআর ম্যাসাকারের সরকারী ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু বিডিআর’এ নিহত সেনা অফিসারদের মৃত্যুর কোন দলীয় এবং আদর্শগত ভিত্তি ছিলনা, তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের মৃত্যুও কোন পূর্ণাংগ মানুষের মৃত্যু ছিলনা। একদল "পূর্ণাংগ" মানুষের দলীয় মগজে সেনা অফিসারদের মত দলহীন, মেরুহীন অপূর্ণ মানুষদের মৃত্যু কতটা দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করেই বোধহয় রচিত হয়েছে হত্যাকান্ডের উপর সরকারী উপন্যাস।
সময়টা ছিল জেনারেল জিয়ার উত্তরসূরী জেনারেল এরশাদের সময়। সীমাহীন লুণ্ঠন বাংলাদেশে ততদিনে রাজনৈতিক ভিত্তি খুজে নিয়েছে, র্দুনীতির কাঠামোগত বৈচিত্র আবিস্কারে জেনারেল জিয়ার উচ্ছিষ্ট ল্যফট্ন্যান্টের দল দিনরাত গবেষনা করে চলছে এরশাদের জাতিয় পার্টির ছত্রছায়ায়। পাশাপাশি দুই বেগমের সেনাপতিরা ক্ষমতার স্বাদ হতে লম্বা সময় ধরে বঞ্চিত হয়ে বুলিমিয়া রোগের দারপ্রান্তে প্রায়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা দখলের রশি টানাটানিতে নতুন এবং এফ্যাক্টিভ ফ্যাক্টর হয়ে উদয় হয় লাশ। লাশের গন্ধ কুকুরের মত টানতে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের। একদিকে ক্ষমতার আলী বাবা, অন্যদিকে ক্ষুধার বাসন্তীর দল, এই দুইয়ের মাঝে তফাৎ হয়ে দাড়ায় লাশ। প্রতিদিন নেতা-কর্মীর দল উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকে নতুন লাশের খবরের আশায়। আবার একই লাশ নিয়ে শুরু হয় ত্রিমূখী টানাহেচড়া। এমনি এক লাশের দাবি জানাতে আওয়ামী নেতারা ঢাকার তেজকুনী পাড়ার দিকে ধাবিত হয় সদলবলে, বজ্রমুঠী আর পেটে ক্ষুধার দাউ দাউ আগুন তাদের চলার পথে নতুন মাত্রা যোগ করে। অন্যদিকে আমানুল্লাহ আমান এই লাশ কিছুতেই আওয়ামী শিবিরে যেতে দেবেন্না, যে করেই হোক লাশের জাতিয়তাবাদী সৎকার করতে এই তরুন নেতা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দু’দলেরই অফিস হতে লাশের মালিকানা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়ে গেছে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে এই মৃত্যু যে বিফলে যাবেনা তা নিয়ে নেত্রীদ্বয়ও ভাষন দিয়ে ফেলেছেন, এক কথায় ফেরার কোন রাস্তা নেই। দু’দল যখন লাশের মালিকানা নিয়ে মুখোমুখি তখনই মৃতের স্ত্রী এসে দাবি করল এ লাশ রাজনীতির লাশ নয়, নেহাতই ঠেলা গাড়িওয়ালার মৃতদেহ, হাংগামার বেড়াজালে আটকে প্রাণ হারিয়েছে। যে যুদ্ব শুরুই হয়নি তাতে দু’পক্ষ রনে ভংগ দিয়ে রওয়ানা দিল নতুন এক লাশের সন্ধানে। পথচারীদের দয়া ভিক্ষায় স্ত্রী তার মৃত স্বামীর দাফন করতে বাধ্য হয় মেরুর মাটিতে বেওয়ারিশ প্রায় লাশ। ঢকা বিশ্ববিদায়লয়ে দু’টি লাশ পরেছে, এরশাদের ছাত্র সমাজের লাশ। কবি এরশাদ কবির ভাষায় বর্ণনা করলেন এই অপমৃত্যুর বিভিষিকা। দিন শেষে নিশ্চিত হল, দু’টি নয় আসলে লাশ পরেছে একটি, অন্যটি লাশ হলেও পূর্ণাংগ মানুষের লাশ নয়, একজন মেরুহীন রিক্সাওয়ালার লাশ। ত্যাক্ত বিরক্ত ক্ষমতাসীন দল হেলিকপ্টারে চড়িয়ে পূর্ণাংগ লাশ পৌছে দেয় তার শেষ ঠিকানায়, অপূর্ণ লাশের সৎকার করতে এগিয়ে আসে আঞ্জুমান এ মফিদুল ইসলাম। বাস, ট্রাক আর গরুর গাড়িতে চড়ে জীবনের শেষ জার্নি সমাপ্ত করে বেচারা রিক্সাওয়ালা।
সেনা ছাউনির চুরি চামারী বাংলাদেশের র্দুনীতির বাজারে নতুন কোন পন্য নয়, এ পন্য রাজনৈতিক চুরি চামারীরই সগোত্রীয় ভাই। এরা একে অন্যের সহায়ক এবং নিয়ামক শক্তি হিসাবে বেচে থাকে। বিডিআর’এ সেনা অফিসারদের প্রেষনে প্রেরনের অন্যতম কারণ হচ্ছে সীমান্তের লূটের পয়সায় ভাগ বসানো। বিদেশী মিশনে কাজ করে কিছু নগদের মুখ দেখা ছাড়া সেনা অফিসারদের ভাগ্য ফেরানোর একটাই রাস্তা খোলা থাকে, তা হল বিডিআর’এ যাওয়া। একজন সেনা অফিসার তার সার্ভিস সময়ের সবটাতেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে সে মহেন্দ্রক্ষনের। শুধু বিডিআর’এ গেলেই যথেষ্ট হবেনা, দেখতে হবে বাংলাদেশের কোন সীমান্তে সে যাওয়া। কারণ সব সীমান্তে সমান আয় হয়না। এ নিয়েই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। মাঝে মধ্যে ভারতীয় বিএসএফ’এর সাথে গোলাগুলি করে তারা জাতীয় খবরে চলে আসে যা আমাদের মত সাধারণ মানুষদের ভারতকে ঘৃনা করতে রসদ জোগায়। কিন্তূ একটা খবর জাতীয় খবর হয়না, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সব গোলাগুলিই চোরাই কারবারীর বখড়া নিয়ে দুই সীমান্ত বাহিনীর হাতাহাতি মাত্র। সীমান্ত বাসিন্দাদের জীবন আর চোরাইকারবারীতে রাজনীতি এবং সেনা অফিসারদের সহাবস্থানের কথা কোন উপকথা নয়, এ আকাশ আর মাটির মতই সত্য। এ সত্যই বিডিআর’এ কর্মরত সাধারণ সেপাইদের মনবেদনার অন্যতম কারণ, কে চায় রান্না করা ভাতে আগন্তূকদের ভাগ?
বিডিআর সেপাইদের কি জানা ছিলনা সেনা অফিসারদের কচুকাটা করলে কোর্টমার্শাল শেষে তাদের রশিতে ঝুলানো হবে? বোধহয় জানা ছিল, প্রশ্ন জাগে, জেনে শুনে কেন তারা রশিতে ঝুলতে গেল! এখানেই আসে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার সন্দেহ। বিদ্রোহীর দল খুনের আগে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতাদের সাথে দেখা করেছে, নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। সরকারী উপন্যাসে সে কথার কোন বিবরন নেই, যেমন নেই কোন দূর দৃষ্টতার বিচারে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহী নেতা ডিএডি তৌহিদকে জরুরী ভিত্তিতে বিডিআর প্রধান হিসাবে ঘোষনা দিয়েছিলেন। নাকি আজম চৌধুরীর মামলা প্রত্যাহারের মত সে সত্যও প্রত্যাহার হয়ে গেছে? প্রশ্নটা অন্যভাবে করা যায়, শেখ হাসিনা এবং তার সদ্য জেল ফেরত ফেরেশতা দলের কি এমন হারানোর ছিল সেনা অফিসারদের মৃত্যুতে? সেনাছাউনির বিরুদ্বে হাসিনার ক্ষোভ অনেকদিনের; পিতা, মাতা, ভাই বোন সহ পরিবারের সবাইকে হারাতে হয়েছে এই বাহিনীর পশুত্বের কাছে, তাদেরই কারণে এক বছর ধরে জেলের ভাত খেতে হয়েছে, চাঁদাবাজি চুরি চামারি সহ আয়ের সব পথ বন্ধ হয়েছে তাদেরই কারণে। সুতরাং এই বাহিনীর এলিটদের বিডিআর জওয়ানরা কচু কাটা করছে এমন সংবাদে শেখ হাসিনার মমতা উথলে উঠবে এমনটা আশা করা হবে দূরাশা মাত্র। বরং প্রতিশোধের যে মিশন নিয়ে শেখ কন্যা রাজনীতিতে এতদিন আকরে ছিলেন বিডিআর জওয়ানরা সেনা অফিসার হত্যার মাধ্যমে সে মিশনের অনেকাংশই পূর্ণ করে দিয়েছে। মার্কিন দেশে ৯/১১’এর ঘটনায় শত শত নীরিহ মানুষের মৃত্যুর পর সৌদি আরবের হারেম শরীফগুলোতে দুম্বা জবাই করে, আকাশে গুলি ছুড়ে উদযাপনা করেছিল মানব হত্যার উৎসব। আবার বাদশাহী সাম্রাজ্যের যুবরাজ তালাত বিন সৌউদ দশ মিলিয়ন ডলার পকেটে পুরে ভিক্ষা দিতে এসেছিলেন নিউ ইয়র্ক বাসীদের। মেয়র জুলিয়ানী ঘৃনাভরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এমন গরু মেরে জুতা দানের ভিক্ষা। বিডিআর হত্যাকান্ড নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ্দের সমসাময়িক আহাজারি ৯/১১ উত্তর সে ঘটনার কথাই মনে করিয়ে দেয়। দুঃখ নয়, সেনাহত্যার খবর বরং আনন্দ বয়ে এনেছিল জেলখাটা চোরদের অন্তরে।
একজন তোরাব আলী , লেদার লিটন এবং পিন্টুকে ভিলেন বানিয়ে বিডিআর হত্যাকান্ডে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে খাটোকরা ছিল খুব সহজ, কারণ এদের উপরের লেভেলে কাউকে সনাক্ত করতে গেলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর রোষানল হবে শেষ রায়। কমিশনের কেউ এমন কাজ করে নিজের মা-বাবার দেয়া পৈত্রিক জান নিয়ে বাজি খেলবে বাংলাদেশে ইহকালে তা সম্ভব নয়। তাই আসুন, হত্যাকান্ডের উপর সরকারী উপন্যাসকে বেষ্ট থ্রিলার হিসাবে গন্য করে এর সবটুকু উপভোগ করতে চেষ্টা করি।