মাঝে মধ্যে রাজনীতি পাগল ২/১ জন প্রবাসী বন্ধুকে তাদের রাজনৈতিক পাগলামী নিয়ে খোচাখুচি করতে মন্দ লাগেনা। ছহুল মিয়া আর ছুয়ফুল মিয়া তাদেরই দু’জন। দু’জনই সিলেটি, তাদের কাছে সিলেটই আসল দেশ, বাংলাদেশ অনেকটা জেলা শহরের মত। ইংল্যান্ডের দক্ষিন ডেভনশায়ার কাউন্টির টোর্কি শহরে পরিচয়, স্মার্ট এবং চোস্ত ইংরেজী জানা মাছে-ভাতের বাংলাদেশী-কাম-সিলেটি। এস-এস এন্টারপ্রাইজ নামের একটা সাপ্লাই ব্যবসা নিয়ে দুজনেই ঘুরে বেড়ান বৃটিশ দ্বীপ পুঞ্জের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্েত। দু’জন ঘনিষ্ট বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার হলেও এক জায়গায় দু’জনের অবস্থান দুই মেরুতে; রাজনীতি! ছহুল মিয়ার কাছে পৃথিবীর আরেক নাম বিএনপি, সাইফুর আর খালেদা জিয়া। এ প্রসংগে উনার সাথে কোন তর্ক চলেনা, এক কথায় সাইফুর আর খালেদা জিয়ার জন্ম না হলে বাংলাদেশেরই জন্ম হতনা। ছয়ফুল মিয়া জাতির পিতা এবং তার বংশধরদের জন্যে শুধূ ব্যবসা কেন নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও সব সময় প্রস্তূত। স্থানীয় আওয়ামী লীগে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমান করে থাকেন। ছহুল মিয়া রাজনীতি নিয়ে বাংলারশেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার মত ভাষন দিতে ভালবাসেন; ... জাতীয়তাবাদের মৃত্যু নেই, কাসিম বাজার কুঠির ষড়যন্ত্র ইসলামী মূল্যবোধের রাজনীতিকে স্তব্দ করতে পারবেনা,... টেকনাফ হতে তেতুলিয়া গর্জে উঠবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ দিক দিয়ে ছুয়ফুল মিয়াঅবশ্য একবারে খালেদা জিয়ার মত বোবা।
ইংল্যান্ড ছেড়েছি আজ অনেকদিন, কিন্তূ ছহুল, ছুয়ফুল, মুতু, এবং নিজাম ভাইদের সাথে যোগাযোগটা অনেকটা হাল্কা হয়ে এলেও বজায় রেখেছি। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয়, ব্যক্তিগত প্রসংগ শেষ হতেই এসে যায় রাজনীতি। ইদানিং রাজনীতির প্রসংগ এলেই ছহু ভাই গর্জে উঠেন, হায় হায় করে উঠেন ইসলামী মূল্যবোধের দেশীয় জাতিয়তাবাদের বিরুদ্বে ’আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রে’র কারণে। এ নিয়ে একটু ঠাট্টা-মশকারা করার ইচ্ছে হতেই ছহুল
ভাইকে চেপে ধরলাম; ’ভাই, আপনি কি রোজা-নামাজ করেন?, - তা করিনা, কিন্তূ গোলাপগঞ্জের নিজ বাড়িতে বিশাল মসজিদ করে দিয়েছি যেখানে হাজার হাজার মুসুল্লী নামাজ পরে আমার জন্য দোয়া করছে’। ’আপনি কি মদ খান? - তা খাই, কিন্তূ তাই বলে নেশা করিনা। ’জুয়া খেলেন?’। ছহুল ভাইয়ের সাথে টোর্কিতে পরিচয় হলেও পরিচয়টা গভীর হয় মিডল্যান্ড কাউন্টির উলভারহ্যাম্পটন শহরের একটা ক্যাসিনোতে। লন্ডন হতে আমরা চার বন্ধু ঐ শহরে গেছি বেড়ানোর উদ্দেশ্যে, সন্ধ্যা হতেই একটা ক্যাসিনোতে ঢুকেছি কিছুটা সময় কাটানোর জন্যে। কিন্তূ যা হবার তায় হল, চারজনই নেশাগ্রস্থের মত হুমড়ি খেয়ে পরালাম রুলেট বোর্ডের
উপর। রাত পেরিয়ে সকাল হতেই চারজনের পকেট খা খা। লন্ডন ফিরে যাবার বাস ভাড়া নেই কারও কাছে। এমন সময় ক্যাসিনোর অন্য একটা টেবিলে আবিস্কার করলাম ছহুল ভাইকে, বড় দানে জুয়া খেলছেন। পকেটের অবস্থা খুলে বলতেই হা হা করে হেসে উঠলেন। উনিও লন্ডন যাচ্ছেন বামিংহাম হয়ে, সাথে আছে ৭ সীটের ভ্যান।
সূর্য্য ভাল করে উঠার আগেই আমরা রওয়ানা দিলাম। ব্রেকফাষ্ট, লাঞ্চ সবকিছু গেল ছহুল ভাইয়ের উপর দিয়ে, উনি নিজেও খুব আনন্দ পেলেন আমাদের আপ্যায়ন করে। সেই যে আন্তরিকতার শুরু আজও তা অটুট আছে।কিন্তূ এ আন্তরিকতা আমাদের রাজনৈতিক মত-পার্থক্য দূরত করেনি, বরং তা সময় সময় বিপদজনক বাকে আটকে গিয়ে ব্যাপক বিপত্তিসৃষ্টি করেছে। শেষবার যখন উনার সাথে কথা হয় ইসলামী মূল্যবোধের জাতিয়তাবাদের উপর লম্বা একটা লেকচার হজম করতে হয় নীরবে, নিঃশব্দে। উনার জন্যে একটাই উপদেশ ছিল আমার, ইসলামী মূল্যবোধ ব্যক্তিগত জীবন হতে শুরু করুন; মদ, জুয়া আর মেয়ে মানুষ নিয়ে খেলবেন আবার পাশাপাশি ইসলাম এবং জাতিয়তাবাদ নিয়ে লেকচার ঝাড়বেন তা হতে পারেনা।
রাজনীতির এই জটিল এবং অমিমাংসিত বৈপরীত্যের মাঝেও আমাদের বন্ধুত্ব সমান্তরালে চলতেকোন হোচট খায়না, এটাই বোধহয় আসল পাওয়া।