সুত্র,দৈনিক আমাদের সময়,৮ ই জুন ২০০৯, সৈয়দ বোরহান কবীর।
ধন্যবাদ মি. জেনারেল। শেষ পর্যন্ত আপনি আপনার কথা রাখলেন। একজন সেনাপ্রধান হিসেবেই আপনি দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেন। জেনারেল মইনের দ্বিতীয় দফা চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির গুঞ্জন ছিল। কিন্তু সেই গুঞ্জন মিথ্যে প্রমাণ হলো। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল মইন উ আহমেদের চার বছর দায়িত্ব পালনকাল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ঘটনাবহুল। মইন উ আহমেদই একমাত্র সেনাপ্রধান, যিনি দু’বছর অঘোষিতভাবে দেশ চালিয়েছেন আবার উর্দি ছেড়ে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হননি। তিনি জিয়াউর রহমান বা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেননি। অনেক বিতর্কের পরও তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন দায়িত্বশীল এবং অঙ্গীকারপূরণকারী সেনাপ্রধান হিসেবেই চিহ্নিত হবেন।
ভুল-ত্র“টি মিলিয়েই মানুষ। কিন্তু তিনিই প্রকৃত মানুষ যিনি তার ভুলগুলো দ্রুত শুধরে নিয়ে সঠিক পথ খুঁজে নেন। জেনারেল মইন উ আহমেদ সেই ধরনের মানুষ।
মইন উ আহমেদের উদ্দেশে এটি আমার চতুর্থ লেখা।
মইন উ আহমেদকে উদ্দেশ করে আমার প্রথম লেখার শিরোনাম ছিল ‘একদিকে অমরত্বের হাতছানি, অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির সিংহাসন’। ঐ লেখায় আমি তাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে সরে আসার অনুরোধ করেছিলাম। তাকে আমি বলেছিলাম, ‘আপনি একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সহযোগিতা করে, সেনাপ্রধান হিসেবেই অবসর নিন’। আমার লেখার জবাব তিনি দিয়েছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘শুরু থেকেই আমি বলে আসছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আগ্রহী নয়। আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের বা পার্শ¦বর্তী দেশসমূহকে অনুসরণ করতে চাই না’। আমরা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। তাই নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। নির্বাচনের পর আমি একটি অনুষ্ঠানের স্যুটিংয়ে খাগড়াছড়িতে। তখন আমার মুঠোফোনে কল আসে, সেনাপ্রধান আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। ফোনে উচ্ছ্বসিত সেনাপ্রধান তার অঙ্গীকার পূরণের কথা বলেন। তিনি জানান, ‘অবিশ্বাসের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, নির্বাচনের আগের দিনও আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কখন দায়িত্ব নেব’। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বলি, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপনার অবদান জাতি চিরদিন স্বরণ রাখবে’। তিনি আমাকে তার গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। আমি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগদান করি। তার গ্রন্থের একটি নির্মোহ সমালোচনা লিখি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তার ‘শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ’ গ্রন্থটি অসময়োচিত। জ্যোতি বসুর ভাষায় বলতে হয় ‘সময় নিয়ে আত্মজীবনী অনেক বস্তুনিষ্ঠ হয়। যাই হোক, এরপর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার সময় আমি তার কর্তব্য নিষ্ঠা এবং সময়োচিত নেতৃত্বে মুগ্ধ হই। সেনাপ্রধান হিসেবে, ঐ ঘটনায় তিনি যে ধৈর্য্যরে পরিচয় দেন, যেভাবে রাজনৈতিক সরকারকে সহযোগিতা করেন তা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড-এর জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কিন্তু তারপরও গুঞ্জন থাকে, তার চাকরির মেয়াদ কি বাড়ছে?
মইন উ আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের ১২তম সেনাপ্রধান। কিন্তু তার পূর্বসূরীদের থেকে তিনি আলাদা, ব্যতিক্রম। তিনি লে. জেনারেল আতিক, লে. জেনারেল হাসান মশহুদ কিংবা লে. জেনারেল হারুনের মতো গতানুগতিক ধারার সেনাপ্রধান ছিলেন না। তিনি জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের মতো উচ্চাভিলাষী সেনাপ্রধানও ছিলেন না, যারা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন। অথচ তিনি আলোচিত, বিতর্কিত। সিংহাসনের পিছনে চাণক্য ছিলেন তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দু’বছর।
২০০৭ সালে দেশে যখন এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তা চরমে, তখন তার নেতৃত্বেই সেনাবাহিনী জরুরি আইন জারি করে। ইয়াজউদ্দিনের বিতর্কিত এবং অবাঞ্ছিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরিয়ে সেনাবাহিনীর ইচ্ছায় ও সমর্থনে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। দেশের আপামর মানুষ সেদিন সেনাবাহিনী এবং সেনা প্রধানকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়েছিল। সেদিন বিশ্ব বাস্তবতার কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। কিন্তুমইন উ আহমেদের নেতৃত্বে সেদিন সেনাবাহিনী সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করত তাহলে হয়তো আমরা আবারো এরশাদ বা জিয়াউর রহমানের যুগে প্রবেশ করতাম। ওয়ান ইলেভেনের পর অবশ্য মইন উ আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সামরিক কায়দাতেই দেশ চালায়। ক্রমেই তাদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা স্পষ্ট হতে থাকে। দুর্নীতি দমন এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার নামে সেনাবাহিনী সবকিছু লেজে-গোবরে পরিণত করেন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিণত হয় রাজনীতি দমন অভিযানে। কিংবা পার্টি গঠন, রাজনৈতিক সংস্কারের নামে রাজনৈতিক দলে বিভাজন সৃষ্টি এবং মাইনাস টু ফর্মুলার নামে সেনাবাহিনী কার্যত বিতর্কিত হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর ভূমিকা জনপ্রিয়তার তলানী স্পর্শ করে। সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে।
বেশিরভাগ মানুষ ক্ষমতার মোহে থেকে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানে না অথবা জানতে চায় না। তাদের চারপাশের চাটুকাররা সত্য আড়াল করে তাদের শনৈঃ শনৈঃ জনপ্রিয়তার কথা বলে। স্বৈরাচাররা তখন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাষায়। কিন্তু মইন উ আহমেদ ব্যতিক্রম এজন্য তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এইসব কর্মকাণ্ড মানুষ পছন্দ করছে না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজনীতি মুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় মানুষের সায় নেই। তিনি অনুভব করেছিলেন, যে ওয়ান ইলেভেনে এদেশের মানুষ সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আকাঙ্খায়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এদেশের মানুষ মাইনাস টু চায় না। এরপরই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইউ টার্ন করে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তারা দুই নেত্রীর মুক্তিসহ একে একে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকে। অবশেষে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মইন উ আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাপস্খলন করে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়।
মইন উ আহমেদ স্বৈরাচারী নন, তিনি নীরব জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছিলেন।
মইন উ আহমেদ ভুল পথে যেয়ে গোঁ ধরে থাকেননি, পথ পরিবর্তন করেছেন। ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ব্যবহার করেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি জাতিকে একটি নির্বাচন উপহার দিতে সহায়তা করেছেন। জাতিকে পরিচ্ছন্ন ও নির্ভুল ভোটারতালিকা সেনাবাহিনী উপহার দিয়েছে তার নেতৃত্বেই। আর বিডিআর বিদ্রোহে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যৌক্তিক আনুগত্য দেখিয়েছেন। আমি জানি না, জেনারেল মইন উ আহমেদ ইতিহাসে অমর হবেন কিনা। কিন্তু এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নাম কেউ বাদ দিতে পারবে না। জেনারেল মইন উ আহমেদকে হয়তো কেউ প্রশংসা করবে, কেউ সমালোচনা করবে, কিন্তু তাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারবে না। তিনি গুরুত্বপূর্ণই বিবেচিত হবেন।
মি. জেনারেল, বাংলাদেশের ইতিহাসের আপনি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকবেন চিরকাল।