একটা দেশের সূস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সে দেশের সেনাবাহিনী এবং এর প্রধানকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, এমনকি সেনা প্রধানের নামও জনসাধারনকে আকর্ষন করেনা। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ তাত্ত্বিক অর্থে সেনাবাহিনী সরকারেরই অংশ এবং এর মূল কাজ সরকারের আভ্যন্তরীন রাজনীতির আলোকে দেশকে বৈদাশিক শত্রুর হাত হতে রক্ষা করা। কিন্তূ বাংলাদেশের বেলায় এমন সহজ সমীকরন বোধহয় প্রযোজ্য নয় এর অতীত ইতিহাসের কারণে। প্রথমে জেনারেল জিয়া এবং তার পদাংক অনুসরন করে জেনারেল এরশাদ রাজনীতিকে বন্দুকের মুখে জিম্মি করে দেশ শাষন করে গেছেন বছরের পর বছর ধরে। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় সেনা ছাউনির প্রভাব এখন স্বীকৃত সত্য এবং এ প্রভাব দলীয় করণের স্বার্থেই সেনাপ্রধান নিয়োগে দলীয় বিবেচনা প্রধান্য পায়।
জেনারেল মইনকে কোন বিবেচনায় খালেদা জিয়া সরকার সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিল তা বেগম জিয়াই ভাল বলতে পারবেন, কিন্তূ এ নিয়োগ যে তাদের দলীয় স্বার্থে যায়নি ১/১১ই তার প্রমান। অনেক জ্যোষ্ঠ জেনারেলদের পিছনে ফেলে জেনারেল মইন সেনা দপ্তরের সর্বোচ্চ আসনে বসে কেন ১/১১’র মত ঘটনা জন্ম দিতে গেলেন তা নিয়েই যত বিতর্ক। আসলেই কি ছিল জেনারেলের মনে তা বোধহয় কেবল তিনি নিজেই বলতে পারবেন। পরবর্তীতে বই লিখে উনি দাবি করেছেন আল্লাহ্র ইচ্ছায় নাকি এমন কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। খুব সহজ সরল জুচ্চোরী, ১/১১’র পক্ষে সাফাই গাইতে এমন সস্তা ধাপ্পাবাজির প্রয়োজন ছিল মনে হয়না। গায়ের জোড়ে ক্ষমতা দখল করে দলীয় তথা পারিবারিক লুটপাট নিশ্চিত করার যে সাংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিবিদ্রা প্রতিষ্ঠা করেছেন তার সার্বিক চিত্র কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার কিছুটা হলেও নমুনা আমরা দেখেছি ১/১১ পূর্ব দিনগুলোতে। এমন একটা অনিশ্চিত এবং জটিল মুহুর্তে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ জাতির জন্যে কোন অঘটনা ছিলনা, বরং অনেকেই এ অযাচিত এবং অনিয়মতান্ত্রিক হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল চলমান রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ব হয়ে। জেনারেল মইনের যাত্রা তার পূর্বসূরী দুই জেনারেলের মত হয়নি, এখানেই এই জেনারেলের পার্থক্য। দেশে সামরিক শাষন জারী হয়নি, যদিও জাতি এ ধরনের শাষনের জন্যে সর্বক্ষেত্রে তৈরী ছিল। শাষনতন্ত্রিক ছকের ভেতর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে জেনারেলের মিশন বাস্তবায়ন একদিকে যেমন শাষনতান্ত্রিক সংকট তৈরী করেনি, পাশাপাশি নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আর্ন্তজাতিক সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হয়নি। র্দুনীতিতে পর পর ৪ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের উপর এমনিতেই বিশ্ব সম্প্রদায় ছিল চরম অসন্তূষ্ট, তার উপর লগি বৈঠা নিয়ে প্রকাশ্য খুনাখুনি আর্ন্তজাতিক পর্য্যায়ে জেনারেলের আগমনকে মসৃন করেছিল। কথিত লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে উঠানোর যে বানী জেনারেল মইন প্রচার শুরু করেছিলেন তাতে অনেকেই সন্দেহ শুরু করেন তার সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক উচ্চাভিলাশ নিয়ে। জেনারেলদের রাজনৈতিক উত্থানকে পূজি করে দেশের অনেক ভেটের্যান রাজনীতিবিদ ইতিমধ্যেই সূফল ঘরে তুলেছেন যার প্রমান আজকের জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির অনেক নেত্রীবৃন্দ। ক্ষমতায় চড়ে রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের নতুন সূযোগের প্রত্যাশায় চলমান রাজনীতির অনেক রাঘব বোয়াল হঠাৎ করেই বনে যান সংস্কারবাদী, অনেকে আবার নতুন দল গঠন করে অপেক্ষায় থাকেন জেনারেল মইনের ইশারার প্রত্যাশায়। কিন্তূ জেনারেল সে পথেও যান্নি, বরং দিনান্তে ক্ষমতা লিপ্সু সেই রাজনীতিবিদ্দের অনেককেই র্দুনীতির মামলায় জড়িয়ে জেল-হাজতে পাঠিয়ে গোলক ধাধায় ফেলেন পন্ডিত বিশ্লেষকদের। ১/১১’র ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার কর্ম পরিধি এতটাই বিস্তৃত করে ফেলে একটা জায়গায় এসে তারা খেই হারিয়ে ফেলে তাদের মূল মিশন নিয়ে, যার প্রমান দুই নেত্রীকে দেশ ছাড়া করার মত হঠকারী সিদ্বান্ত।
বিশ্ব বাজারে চালের অভাবিত মূল্যবৃদ্বি শূধু সাধারণ মানুষের জীবনকেই ব্যহত করেনি, বরং তা ১/১১’র মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে রাজনীতিবিদ্দের কাছে জেনারেল মইনকে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করে। ইতিমধ্যে সেনা ছাউনিতে ঘটে যায় ট্টাডিশনাল বিপ্লব, এমন এক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন দিয়ে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর পূর্বক দৃশ্যপট হতে সড়ে যাওয়ার প্রতিযোগীতায় নেমে পরে জেনারেলের দল। সেইফ এক্সিটের মাধ্যম হিসাবে জেনারেল বেছে নেন শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগকে। দল হিসাবে বিএনপির গ্রহনযোগ্যতা সে সময়টায় জাতির সামনে প্রশ্নাতীত ছিলনা। বিশেষ করে খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সীমাহীন লুটপাটের কাছে জেনারেল মইনের আত্মসমর্পন হত তার ভবিষত ক্যারিয়ারের মৃত্যু।
পর্বের সমাধা শেষে জেনারেল মইন এখন একজন সাধারণ নাগরিক। কিন্তূ রাঘব বোয়াল রাজনীতিবিদ যাদের জেল-হাজতে পাঠিয়ে তাদের চরিত্রের কালো অধ্যায় জাতির সামনে নেংটা করেছেন, তারা এত সহজে এই জেনারেলকে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয়না। আগামীকাল হতে এই জেনারেলের চরিত্র হননের পর্ব শুরু হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। এমন কাজে রাজনীতিবিদ্দের সাথে গায়ে পড়ে যোগ দেবে দেশের মিডিয়া এবং বুদ্বিজীব্রি দল, কারণ ১/১১’র বদৌলতে তাদের চরিত্রের অনেক অজানা কাহিনীও জাতির সামনে উন্মুক্ত হয়েছে।
আমাদের সেনাছাউনিতে অন্যায় এবং অপরাধের মাত্রা কতটা সীমাহীন এবং ভয়াবহ তার কিছু নমুনা উন্মোচিত হচ্ছে ১০ ট্রাক অস্ত্র আমদানী মামলায়। জেনারেল মইন এই অপরাধী চক্রের সর্বোচ্চ আসনে বসে কতটা সৎ ছিলেন ভবিষতই তার বিচার করবে। কিন্তূ জাতিকে ১/১১ উপহার দিয়ে রাজনীতিতে কিছুটা হলেও সচ্ছতা আনায় উনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন তার জন্যে আর কিছু না হোক অন্তত ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।