মুজিব-জিয়া বিতর্ক রাজপথ, শিক্ষাংগন এবং সংসদ ভবন পেরিয়ে শেষ পর্য্যন্ত আদালতে ঠাই নিয়েছে। দেশের সব্বোর্চ আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে জিয়াউর রহমান নয়, বরং শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে আখ্যায়িত করে এ ব্যাপারে জোট সরকারের আমলে গৃহীত দলিলাদির একটা অংশকে অবৈধ, বেআইনী এবং শাস্তিমূলক অপরাধ হিসাবে ঘোষনা দিয়েছে। সূস্থ এবং আইনের প্রতি শ্রদ্বাশীল একটা জাতির জন্যে দেশের সব্বোর্চ আদালতের রায়ই শেষ রায় (আপিল এবং সুপ্রিম কোর্ট শেষে) হওয়ার কথা, এ বিবেচনায় স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে রক্তক্ষয়ী বিতর্কের এখানেই বোধহয় পর্দা পরা উচিৎ ছিল। কিন্তূ বাস্তবেও কি এমনটা ঘটতে যাচ্ছে?
কিছুদিনের ভেতর দেশের হাইকোর্টে নতুন ক’জন বিচারক নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন, এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্বান্ত প্রায় চূড়ান্ত। সরকার বদলের সাথে সাথে দেশের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে নতুন বিচারক নিয়োগ অনেকটা রাজনৈতিক সাংস্কৃতিতে পরিনত হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারও এ চর্চার বাইরে যেতে চাইছেনা। এ ব্যাপারে বিশেষ জ্ঞান না থাকলেও বিচারকের আসন কারা অলংকৃত করতে যাচ্ছেন এ ব্যাপারে ভবিষতবানী করা খুব একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার বলে মনে হয়না। আওয়ামী ঘরনার আইনজীবিদের ধূয়ে মুছে বিচারকের আসনে বসানো হবে দলীয় স্বার্থের আইনী দিক দেখভাল করার জন্যে, বিশেষকরে পরবর্তী সরকারগুলো যখন নেতা-নেত্রীদের কৃতকর্মের পাপমোচন করতে আইনের হাতে সপে দেবে তখন। এটাই আমাদের বিচার ব্যবস্থার দুখঃজনক বাস্তবতা। এমনটা করেছিল গত বিএনপি-জামাত জোট সরকার, এরশাদের স্বৈর সরকার এবং আগের টার্মের আওয়ামী সরকার। শুধু দলীয় বিবেচনাই নিয়োগ প্রাপ্তি যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি থাকা চাই নেত্রীর সূনজর। বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রীর নিয়োগ নিয়ে খোদ ক্ষমতাসীন দলেই রয়েছে অনেক ক্ষোভ এবং অসন্তূষ্টি। এমন নিয়োগের পক্ষে সাফাই গাইতে নিয়োগকর্তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অন্য এক কাহিনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনী যাতাকলে প্রধানমন্ত্রীকে যখন চাপাতি বানানো হচ্ছিল ব্যরিষ্টার শফিক সে র্দুদিনে উনার পাশে দাড়িয়েছিলেন নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রধানমন্ত্রী এই নিঃস্বার্থ সেবককে পুরস্কৃত করতে ভূলেন্নি, যেমনটা ভূলেন্নি ব্যক্তিগত চিকিৎসক মোদাচ্ছেরকে মূল্যায়ন করতে।
বিচারক নিয়োগের প্রসংগটা টানার একটা লক্ষ্যনীয় দিক আছে, ধরে নেই সামনের নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখান করে আবারও বিএনপি-জামাত জোটকে ক্ষমতায় বসালো। স্বভাবতই পুরানো বিচারকদের পাশাপাশি নতুন ক’জন বিএনপি ঘরনার আইনজীবি বিচারক হিসাবে নিয়োগ পাবে। নতুন সরকার আবারও হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্টে যাবে স্বাধীনতার ঘোষক সমস্যা সমাধানের জন্যে। পাঠক, কি মনে হয়, হাইকোর্ট কি বহাল রাখবে আওয়ামী আমলের রায়? দলীয় বিচারক নিয়োগের এটাই বোধহয় মূল স্বার্থকতা।
শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যতটা ব্যতিব্যস্ততা দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে সূযোগ বোধহয় হাতছাড়া হওয়ার পথে! আইন করে নেতাকে ঘোষক বানাতে গিয়ে দলটি প্রকারান্তে শেখ মুজিবকে হেয় এবং ছোট করে স্বৈরশাষক জিয়ার পর্য্যায়ে নামিয়ে আনছে। স্বাধীনতার ঘোষনা একটি ঐতিহাসিক দলিল, আবেগের দলিল নয়। আবেগের উর্ধ্বে উঠে এমন একটা দলিল নিয়ে আমরা যদি ঘাটাঘাটি করতে যাই কোথাও কি শেখ মুজিবের স্বাক্ষরিত ঘোষনার কোন প্রমান বের করতে পারব? হ্যাঁ, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় এই অবিংসবাদী নেতার ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। কিন্তূ আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল কেবলমাত্র একব্যক্তির ঘোষনায় এবং একজন মেজরের বিদ্রোহের কারণে এমন একটা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হবে স্বাধীনতা যুদ্বে প্রাণ হারানো লাখ লাখ মানুষের প্রতি চরম অসন্মান। কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে কে, কখন এবং কার হয়ে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিল ইতিহাসের এ অংশ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যার কোন প্রতিষ্ঠিত দলিল নেই। শুধু এই ঘোষনাকে আলোকিত করে স্বাধীনতার পূরো অধ্যায়কে মূল্যায়ন করা হবে অবিবেচকের কাজ। আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব ঘরনার বিচারক দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষকের ফয়সালা করে তেমনি এক অবিবেচকের কাজ করল, যার মূল্যায়ন হবে দলভিত্তিক, সার্বজনিন নয়। শেখ মুজিবকে হাইকোর্টের রায় নিয়ে জাতির পিতা অথবা স্বাধীনতার স্থপতি বানানো হবে একধরনের এঞ্জিনীয়ারিং যা হয়ত সময় এবং বাস্তবতার চাহিদা মেটাবে, ইতিহাসের নয়। কাউকে শতাব্দির সেরা সন্তান জোড় করে বানানো যায়না, এ ধরনের মূল্যায়নের জন্যে চাই জনগণের আকুণ্ঠ এবং স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন। শেখ মুজিবকে এ ধরনের মহামানব আখ্যায়িত করতে দেশের কোটি মানুষের শুধু সমর্থনই নেই, রয়েছে বিরোধীতা।
দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির কারণে জনজীবন চরমভাবে বিপর্য্যস্ত, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থীতি আয়ত্তের বাইরে, মন্ত্রীদের অযোগ্যতার কারণে সরকারের যাত্রা এলোমেলো। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ৩৮ বছরের এ অমিমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে শুধু দলীয় ক্ষমতাকেই নিশ্চিত করবেনা, বরং প্রায়ত নেতা শেখ মুজিবকেও সার্বজনীন প্রতিষ্ঠা দিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। মুখে মুজিব নামের ফাকা বুলি আর অন্তরে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরির ধান্ধাবাজি, এসব করে ঘোষক নামের কীর্তন গেয়ে ইতিহাস বদলানো গেলেও জনগণের মন জয় করা যায়না। শেখ মুজিবের স্বীকৃতি আসতে হবে জনগণের সন্মান, শ্রদ্বা এবং ভালবাসার চাওয়া পাওয়া হতে, হাইকোর্টের দলীয় বিচারকদের কলম হতে নয়।