নীচের ব্লগটির প্রকৃত লেখক সজল শর্মার অনুমতি নিয়ে এই ওয়েবসাইটে লেখাটি পূনঃপ্রকাশিত করা হল।
আমি সাধারণত রাজনীতি নিয়ে কোন কথা বলি না। মাঝে মাঝে দু’এক জায়গায় মন্তব্য করি। এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে আমি নিজেকে নিরপেক্ষ বলেই পরিচয় দেই। কারণ এমন কোন দল নেই যাকে আমি মনে প্রাণে পূর্ণ সমর্থন দিতে পারি। আজকে কেন জানি মনে হল- রাজনীতি নিয়ে একটু নিজের মতামত ব্যক্ত করি। সেই কারণেই এই লেখার অবতারণা। বর্তমান কিছু বিষয় নিয়েই কথা বলব।
বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে- তা তো প্রায় মাস ছয়েকের উপরে হতে চলল। আওয়ামীলীগ বিপুল সখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে জয়লাভ করলো। বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে জনগণ যে কারণে ভেতরে ভেতরে তখনকার সরকার ব্যবস্থার উপর নারাজ ছিল, তার অন্যতম কারণ দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, সিন্ডিকেট। আরও অনেক কারণ আছে- সেদিকে যাচ্ছি না। তারপরে আমাদের ফখরুদ্দিন সাহাবের সরকার বাংলাদেশের অনেক প্রচলিত রীতিকে ভঙ্গ করে দূর্ণীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত হত এবং দ্রুত কার্যকর হত। এই ব্যাপারটি সরকারের অবস্থানকে উপরে তুলেছিল। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের কারণে এই সরকারের জনপ্রিয়তা ষোলকলায় পূর্ণ হয়নি। তারপরে নির্বাচন এলো- নতুন সরকার গঠন হলো। নির্বাচনের ফলাফল থেকেই বুঝা যায় দেশের জনগণ আওয়ামীলীগের উপর কতটুকু ভরসা করেছে। নতুন সরকার এসেছে- অনেকেই বলবেন বেশি দিন হয়নি। ছয় মাসের বেশি সময় কিন্তু অনেক দীর্ঘ সময়।
আওয়ামীলীগ সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কিছু দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরেছে। চালের দাম মানুষের হাতের নাগালে। এই ব্যাপারগুলো এই সরকারের সফলতা বলে ধরা যায়। বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে কিছু বলব না। অন্য প্রসঙ্গের মধ্যে সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। ঘড়ির কাটাকে এগিয়ে নিয়ে লাভ-ক্ষতির যতই হিসাব করা হোক না কেন- যোগান না থাকলে কি আর লাভ আসে। দেশে সব থেকে বড় প্রয়োজন বিকল বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোকে পুনরায় উৎপাদনে নিয়ে আসা। নতুন শক্তিকেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করা। সবাই এখন বলছে- পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সাথে আলোচনার খবর বেরিয়েছে- কিন্তু তেমন অগ্রগতি নজরে আসছে না। এই ছয় মাসের মধ্যে বিদ্যুতের ব্যাপারে তড়িৎ গতিতে কোন ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। সরকারের এমন কচ্ছপগতি তাদের জন্য সফলতা বয়ে আনবে না। পাঁচ বছর তো আর পেরিয়ে যেতে সময় লাগবে না। দেখা যাবে হয়তো- সরকারের শেষ পর্যায়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করা হচ্ছে নির্বাচনে মানুষকে বুঝানোর জন্য। ঐ রাজনীতিতে যদি সরকার চলে যায় তাহলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বর্তমানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। ভারত বাঁধ দিবে, বিদ্যুত তৈরি করবে- এ ব্যাপারে দাদাগিরি দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস সাক্ষী- শক্তিশালী দেশের কাছ থেকে বেশিরভাগ সময়ই এমন আচরণ পাওয়া যায়। বর্তমান সরকারের জন্য দূর্ভাগ্যই বলতে হবে যে ভারত তাদের শাসনামলেই এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছে। ভারতপন্থী বলে আওয়ামীলীগের বদনাম আছে- তা এখন আরও জোরদার হচ্ছে। ভারত জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে দিলে কিছুই করা যাবে না, বাংলাদেশের অন্য সরকার থাকলেও পারত না। আমরা তো আর অস্ত্রের ভয় দেখাতে পারব না। আমাদেরকে বিচার চাইতে হবে জাতিসংঘের কাছে বা অন্য দেশের কাছে। আর বিচারের ফলাফল যাই হোক না কেন তা যে দুর্বল দেশের বিরুদ্ধে যায়, ইতিহাস এ ব্যাপারেও সাক্ষ্য দিবে। তো যাই হোক- টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাতে কিন্তু জনগণ সরকারের উপর খুশী হতে পারছে না। তারওপর বাংলাদেশের কূটনৈতিক জ্ঞানশূণ্য মন্ত্রীদের বেফাঁস বক্তব্যে জনগণ আদৌ খুশী হচ্ছে না। এখানে মহাশয়া খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার চেয়েও বিচক্ষণ মনে হয়েছে। তিনি সরকারে না থাকলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। ভোটের সময়ে এই সামান্য প্রয়াসটুকু খালেদা জিয়াকে অনেক সহায়তা করবে। চিঠির ফলাফল কি হবে, ভারত সরকার কি ব্যবস্থা নেবে- সেসব পরের কথা। দেশের জনগণের কাছে এই উদাহরণ অনেক বড় হয়ে দেখা দিবে। শেখ হাসিনা চাইলে অনেক ব্যবস্থা নিতে পারতেন, বাঁধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারতেন। ফলাফল কি আসে- সেটা ছিল পরের বিষয়। ভারত তখন জোর করে বাঁধ দিয়ে দিলেও এর দোষ সরকারের ঘাড়ে পড়ত না। যদিও বিরোধী দল তখন এ নিয়ে মাঠ গরম করতে চেষ্টা করত।
আওয়ামীলীগ যদি ভেবে থাকে যে এত বিপুল সমর্থনের পর বাংলাদেশের জনগণ তাদেরকে আর ছাড়বে না, তাহলে সেটা মস্ত বড় এক ভুল করছে তারা। বাংলাদেশের জনগণ দুই তীরের মাঝেই সীমাবদ্ধ। হয় আওয়ামীলীগ, না হয় বিএনপি। আওয়ামীলীগ মনের মত কাজ না করতে পারলে বিএনপির পাল্লা ভারি হতে থাকবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আওয়ামীলীগ যদি ভেবে থাকে যে তারেক আর কোকোর ঘটনায় জনগণ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে- তাহলে এটা হবে মস্ত বড় ভুল ধারণা। কারণ বাংলাদেশের মানুষ দূর অতীতের চেয়ে নিকট অতীত বা বিগত বর্তমানের কথাই মনে রাখে বেশি- ইতিহাস সাক্ষী আছে। আগামী নির্বাচনের সময়ে বিএনপির দূর্ণীতির ঘটনা দূর অতীত হয়ে যাবে, মানুষ তখন হিসেব করবে আওয়ামীলীগ সরকার কি দিয়ে গেল। সরকারের কাজের উপরেই নির্ভর করবে- কে পার হবে নির্বাচনের বৈতরণী। আর বিএনপির দূর্ণীতি নিয়ে এত খুশী হওয়ারও কারণ নেই, স্বয়ং আওয়ামীলীগ কিন্তু তুলসী পাতার মত নয়। বাংলাদেশের মানুষ- ঠিক নদীর এপার আর অপারের সুখ কাহিনী নিয়েই ব্যস্থ থাকে। আওয়ামীলীগ মনের মত কাজ না করলে বলবে- ইস্ বিএনপিকে ভোট দিলে হয়তো ভাল হত। বিএনপির কাজে খুশী না হলে বলবে- নৌকায় ভোট দিলেই ভাল হত। যেহেতু এখন আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করেছে আগামী নির্বাচনের জন্য কিছু করতে হলে ভেবেচিন্তে ভাল কাজগুলো প্রথম থেকেই করতে হবে। তা না হলে- বিএনপি যদি কোন কিছু না করে, কোন প্রচারণা না চালায়- তারপরেও ওদের পাল্লা ভারি হতে থাকবে।
শেখ হাসিনাকে এবার অনেক ক্ষেত্রেই সঠিভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। অতীতের মত ভুলের দিকে না গিয়ে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক আছেন তিনি। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার সাথে কাজ না করলে সামনে আবার পরাজয়ের মুখ দেখতে হবে। ছাত্ররাজনীতির বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ঘটনা আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা এই কমসময়ের মাঝে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এই বিষয়গুলো আওয়ামীলীগকে ভাবতে হবে। তা না হলে- ভবিষ্যতের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে না।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে- ধানের উৎপাদন বেড়েছে। চালের দাম কমেছে। কিন্তু কৃষক ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। এই ভুল বারবার কেন সরকারগুলো করে যায়- তা বুঝা যায় না। কৃষক ন্যায্য মূল্য না পেলে সে উৎপাদন কমিয়ে দেবে, উৎপাদন কমিয়ে দিলে আগামী বছর আবার চাল সংকট দেখা দিবে। চাল সংকট মানে চালের দাম আকাশে উঠবে আর ভেতো বাঙ্গালীর মাথা গরম হবে। ভেতো বাঙ্গালী যে পেটের জ্বলায়- গরম মাথায় সরকারকে আশীর্বাদ করবে না, এই ব্যাপারে তো নিশ্চিত থাকা যায়। শুধু ধানের কথা বললাম। অন্য কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঘোড়ার লাগাম টানা সহজ হবে না।
কিছুদিন আগে ঝড় হয়ে গেল। বর্ষা এসে গেছে- এখন আসবে বন্যা। ত্রাণ সামগ্রী কিন্তু সুষ্ঠভাবে বিতরণ হচ্ছে না। সেই আগের মতই লুটপাট রয়ে গেছে। অতীতের বারবার ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিলে কি ফলাফল আসে তা সরকারকে এখন থেকেই ভেবে রাখতে হবে।
আওয়ামীলীগ সরকারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল অতি দেশ ভক্ত সাজতে যাওয়া। বাংলা ব্যাকরণের অতি উপসর্গ কখনই ভাল ফলাফল বয়ে নিয়ে আসে না। তাই কে স্বাধীনতা ঘোষনা করলো, কে কি করলো- এসব ব্যাপারকে মুখ্য না করে বর্তমান বিষয়গুলোকে মুখ্য করা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ জানেই, সরকার বদলের সাথে সাথে বই পত্রে ইতিহাস কিছুটা পরিবর্তন হয়। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বেশিরভাগ বাঙ্গালীই জানে। যারা দেশের জন্য কাজ করেছেন তাঁদের প্রতি সম্মান সকলেই দেখাবে। তাই এসব নিয়ে এত মাতামাতির কোন কারণ নেই। কেউ সম্মান না জানাতে চাইলে জোর করে রেডিও-টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের কথা ২৪/৭ বলেও তাকে দিয়ে সম্মান দেখানো যাবে না। তাই এসব ব্যাপারকে বড় বিষয় করা উচিত নয়। দেশের অনেক মুক্তিযুদ্ধা এত বছর পরেও অবহেলিত তাদের জন্য কাজ করলে জনগণ খুশী হবে। বক্তব্যসার দেশপ্রেমে কোন কাজ হবে না। রাজাকারদের বিচারের কথা বলা হয়েছে- ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন শুধু যদি রাজাকারের বিচার বিচার করে সময় পার করে দেন- তাহলে কাজের কিছুই হবে না। জনগণ তখন খুশী না হয়ে বিরক্ত হবে।
আজকে দেখলাম- বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিরাপত্তার জন্য নতুন করা হবে। নতুন আইনের আসলেই কি কোন প্রয়োজন আছে? এই আইন করা মানে এটাই প্রমান করা জনগণের নিরাপত্তার জন্য যেসব আইন আছে তা ফলপ্রসূ না। তাই বিশেষ আইন করতে হচ্ছে। বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা এমনিতেই বিশেষ নিরাপত্তা সাহায্য পেয়ে থাকেন। এতকিছু থাকার পরেও আবার আইন করা, জনগণ থেকে দূরে সরে যাওয়ারই সামিল। যেখানে দেশের জনগনই অনেকস্থানে নিরাপত্তার অভাবে আছে- সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এসব আইন বানালে তা সুফল বয়ে আনবে না। তাছাড়া গত আওয়ামীলীগ শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর খুনের বিচার নিয়ে কতকিছু হল। ভাবা হল- যাক, এবার তাহলে খুনীদের ফাঁসী হবে। সেই পাঁচ বছরেও হয়নি। আরও পাঁচ বছর চলে গেলেও হয়নি। আরও দুই বছর চলে গেলেও হয়নি। আর এখন তো চলছে। আইনকে আইনের পথেই চলতে দেন। এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক বিষয় বানিয়ে মাঠ গরম করাকে জনগণ আর পছন্দ করে না। খুনীদের বিচার সবাই চায়- আইনের মাধ্যমেই সেটা হোক। সরকারের প্রভাবে বিচার হলে অনেকেই বিচারের উপর প্রশ্ন তুলবে।
দেশে কিছুদিন পরপর নতুন আইন আসে। এত আইন বানিয়ে কি হবে যদি তার বাস্তবায়ন না হয়। নতুন আইনের প্রয়োজন যখন আইন হোক। কিন্তু রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে, সেতু ভেঙ্গে যাচ্ছে, নদী ভাঙ্গনে মানুষ ঘরবাড়ি হারাচ্ছে- সেসব দিকে খেয়াল হারিয়ে শুধু নতুন আইন বানালে কি আর জনগণ আগামীবারের পাল্লাকে ভারী করবে?
বলতে গেলে আরও অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে আসা যায়। দেখার বিষয় হচ্ছে- বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থায় উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার অভাব। এই অভাবটুকু সত্যিই অভাব না অভাবের অভিনয়- তা চির রহস্য হয়ে আছে। যাই হোক- রাজনীতির আলোচনার আওয়ামীলীগের প্রসঙ্গ বেশি এসেছে কারণ তারা সরকারে আছে। একটি বিষয় না বললেই নয়- আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা নির্বাচনের পরে নির্বাচনের সময়কার জনপ্রিয়তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি নিশ্চিত। সেই ভরাডুবিতে বিদ্যুৎ প্রসঙ্গ ভূমিকা রাখবে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গ ভূমিকা রাখবে, ছাত্রলীগের কার্যকলাপের প্রসঙ্গ থাকবে। বর্তমানেও যদি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে দেখা যাবে- আওয়ামীলীগ গত ফলাফলের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। আর স্বভাবতই সেখানে বিএনপির ফলাফল এগিয়ে যাবে। এটাই রাজনৈতিক সমীকরণ।
- লেখক: সজল শর্মা