বাজার বানিজ্যে আগুন লাগলেই চমৎকার একটা ছবি আমাদের পত্র-পত্রিকার পাতাগুলোকে আলোকিত করে। এই যেমন, গতকাল দেশের সবকটা দৈনিকে বানিজ্য মন্ত্রীকে দেখা গেল কাচা বাজারে হাটাহাটি করতে, দোকানদারদের সাথে মত বিনিময় করতে। পরিপাটি এবং কেতাদুরস্ত মন্ত্রীদের বাজার যাত্রা অনেক সময় সামন্ত যুগীয় রাজা বাদশাদের ইয়ার-দোস্ত সমভ্যিহারে মৃগয়া শিকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ছোটকালে পড়েছি খোলাফায়ে রাশেদিনের দ্বিতীয় খলিফা হয়রত ওমর (আঃ) প্রায়শঃই নৈশবিহারে বের হতেন জনগণের দুঃখ দুর্দশার সাথী হতে, ইরাকের প্রায়ত স্বৈরশাষক সাদ্দাম হোসেনেরও না-কি এ অভ্যাসটা ছিল (কেবল স্বগোত্রীয় সুন্নিদের জন্যে)। ক্ষমতার রাঘব বোয়ালদের এ ধরনের বাজার ভ্রমন খোলা বাজার অর্থনীতির যুগে কতটা প্রয়োজন এবং কার্য্যকরী এ নিয়ে প্রশ্ন করলে অন্যায় কিছু হবে বলে মনে হয়না। গোটা দশেক ফটো সাংবাদিক, ডানে বায়ে টিভি ক্রু নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় হাটছেন আর খুজে বেড়াচ্ছেন বাজারে আগুন লাগার কারণ! এমন একটা অভিনব দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগেনা! মন্ত্রী সাহেব যে জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন কেউ নন অন্তত এমনটা স্বাক্ষী দেবে জেমস বন্ড কায়দার এ ধরনের অভিযান।
রোজা এল বলে। অনন্তকালের অমেঘো ধারায় বাজারে আগুন লাগতে শুরু করেছে। মার্কিন মুলুকের অংগরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা নিশ্চয় জানেন গ্রীষ্মকালটা এলেই ঘুম ভাঙে আগুনে দানবের, যার আগ্রাসনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায় একের পর এক বন-জংগল এবং জনপদ। রোজার মাসে আমাদের বাজারের অবস্থাটাও হয় অনেকটা সে রকম। জ্বলতে থাকে বাজার আর সরকার সে আগুন নেভাতে কালাশনিকভ রাইফেল সহ মাঠে নামিয়ে দেয় কালো বস্ত্রের র্যাব। রবিন হুড আর যর্রো কায়দায় মাথায় কালো সিল্কের মুখোশ এটে ওরা ওৎপেতে থাকে বাজার সন্ত্রাষীদের কব্জা করার জন্যে। অবশ্য এর আগে সচিবালয়ের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার হতে মুহুর্মুহু উচ্চারিত হতে থাকে সাবধান বানী, ‘বাজারে আগুন লাগালে টেনে ফালা ফালা করে ফেলা হবে‘! তবুও বাজারে আগুন লাগে, আর সে আগুন পরিদর্শনে মন্ত্রী মহোদয়দের তশরিফও অব্যাহত থাকে।
আজকের পত্রিকায় খাদ্যমন্ত্রী রাজ্জাক সাহেবের একটা মনতব্য পড়ে চমকে উঠলাম। এমন একটা বাকা মনতব্যের পর আনাড়ি এ মন্ত্রীর চাকরী থাকবে কি না এ নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। মন্ত্রী বলেছেন, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণেই না কি পন্যের মূল্য শতকরা ৭০ভাগ বেড়ে থাকে। দাড়ান মন্ত্রী মহোদয়, আপনি চাঁদাবাজির প্রসংগ টানলেন, স্বাভাবতই প্রশ্ন আসবে কারা করছে এ চাঁদাবাজি আর কেনইবা আপনারা পারছেন্না তা ঠেকাতে? তাহলে এ চাদাঁবাজিও কি প্রতিপক্ষ বিএনপির ষড়যন্ত্র অথবা রাজাকারদের দেশ বিক্রীর মাষ্টার প্ল্যানের অংশ? আপনারাই ভাল জানবেন এর উত্তর। অতীত কিন্তূ এ কথা বলেনা, চাঁদাবাজদের গডফাদার কিন্তূ আপনারা ক্ষমতাসীনরাই, এদের হাত ধরেই কিন্তূ আপনারা ক্ষমতার সিড়ি ভাঙেন। আপনাদের নির্বাচনী প্রচারনার দু’একটা ছবি যদি সংরক্ষন করা যেত তা হলে আপনাদের ডানে বায়ে এদের চেহারাই দেখা যেত। আপনারা কি বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করতে পারবেন চাঁদাবাজির একটা সিংহাভাগ অলিগলি ঘুরে আপনাদের পকেটে ঠাই নেয়না? তাই যদি না হবে তাহলে কোন আশ্চর্য্য প্রদীপের ঘষায় আপনাদের ব্যাংক ব্যালেন্স সহসা স্ফীত হয়ে উঠে, সন্তানাদি সমুদ্র মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় সভ্যতার অভয়ারন্যে, বাড়ির আংগিনায় শোভা পায় মৃগয়া, ময়ুরী আর ময়না পাখিদের মেলা?
হবুচন্দ্র রাজ্যে গবুচন্দ্র মন্ত্রীদের প্রধান কাজ হচ্ছে রাজা হবুর গায়ে-গতরে তৈল মর্দন করে মন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখা। আমাদের অতি চতুর মন্ত্রীদের বাজার নিয়ে মহা শংকার হম্বি তম্বি এক ধরনের চাটুকারীতা বৈ অন্য কিছু নয়। আমাদের ভাল করেই জানা আছে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি না চল্লে ১০/২০ কোটি টাকার মনোনয়ন বানিজ্য মাঠে শুটকি হবে, আর মন্ত্রীরাও হারাবে মন্ত্রীত্বের তৃষ্ণা। খবরে জানা গেছে ভারতের আগরতলা প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রীর ব্যাংক ব্যালেন্স ২৭ হাজার রুপি। আমাদের বাগরম্বর মন্ত্রীরা যদি নিজদের ব্যাংক ব্যালেন্সও এ রকম স্বাস্থ্যহীন রাখতে পারতেন তাহলে বাজারে আগুন লাগানোর জন্যে দালাল খুজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।