এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ১০ম পর্ব

Submitted by WatchDog on Friday, October 9, 2009

Andes Mountains - South America

মাইল খানেক হাটার পর জট্‌লাটা চোখে পরল। ড্রাইভার এবং ট্যুর গাইডদের সাথে পাহাড়ি এলাকার মাম্বো জাম্বো টাইপের ক’জন কি নিয়ে যেন দরকষাকষি করছে। দু’পক্ষকেই বেশ উত্তেজিত মনে হল। বন্দী দশা সইতে না পেরে অনেক যাত্রীও নেমে এসেছে খোলা বাতাসে। অধৈর্য্য এবং উৎকণ্ঠার ছাপ সবার চোখে মুখে। ৭ দিন ধরেই চলছে অবরোধ নামের ক্যাট & মাউস গেইম। আজ শনিবার, অনেকেই ভেবেছিল অন্তত ছুটির দিনটায় রেহাই পাওয়া যাবে ধর্মঘটীদের টাগ অব ওয়্যার হতে। দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলো চাইছে বলিভিয়ান সরকার গ্যাস কোম্পানীগুলো জাতীয়করন করুক। তাদের অভিযোগ, বিদেশীরা যুগ যুগ ধরে এ দেশের গ্যাস সম্পদ র্দুনীতিবাজ সরকারগুলোর সহযোগীতায় বিদেশে পাচার করে নিজদের পকেট ভারী করছে। পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছে আদিবাসীদের বেচে থাকা। মূলত তাদের স্বার্থেই এ ধর্মঘট। চারদিক তাকালে মনে হবে বিশ্ব ব্রম্মান্ডের কোন এক আশ্চর্য্যতম গলিতে বন্দী হয়ে গেছি আমারা। একদিকে এন্ডিসের বিশালতা, পাশাপাশি মাইলের পর মাইল খোলা মাঠ, সমান্তরালে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। এখানে আধূনিক প্রযুক্তি নির্বাসিত, নেই মুঠো ফোনের রাজত্ব। বহুদূরে ক’টা জংলী মহিষ এবং আলপাকাদের অলস চলাফেরা মনে করিয়ে দেয় সৌরজগতের অন্যকোন গ্রহ নক্ষত্র নয়, এ আমাদেরই প্রিয় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও।

এন্ডিসের যে বাকটাতে আমরা আটকে আছি তার শেষ প্রান্তটা বেশ অদ্ভূদ দেখাল দূর হতে। রাস্তার দু’পাশের পাহাড়গুলো হঠাৎ করে যেন এক বিন্দুতে মিলে গেছে। গুহার মত দেখায় নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাকা রাস্তা হতে দেখলে। মোক্ষম জায়গা ট্রাফিক আটকানোর! হঠাৎ করে সামনের জটলায় সবাইকে কেমন উত্তেজিত মনে হল। মিনিট পাচেক না যেতেই এক দল অন্য দলকে ধাওয়া শুরু করে দিল। চারদিকে বন্য চীৎকারে খানখান হয়ে গেল এন্ডিসের নির্জনতা। আংগুল উচিয়ে পাহড়ের দিক কি যেন দেখাতে চাইছে অনেকে। ও দিকে চোখ ফেরাতেই হীম হয়ে গেল সমস্ত শরীর। কিং কং কায়দায় হাতে পাথরের বড় বড় টুকরা এবং তীর ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা ঘেরাও করে ফেলেছে আমাদের। ভেতরের সষ্ঠ ইন্দ্রীয় একসাথে বলে উঠল পালাতে হবে আমায়। শুধু আমি নই, যতদূর চোখ যায় সবাই দেখলাম দৌড়াচ্ছে। পালাচ্ছে যুদ্বের মাঠে পরাজিত সৈনিকদের মত, কারন পেছনে ধেয়ে আসছে সাক্ষাৎ আজরাইল। কেউ একজন খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিল, পরনের কাপড় ফেলে দৌড়াতে শুরু করল সে। লেভ টলষ্টয়ের কালজয়ী উপন্যাস ’ওয়্যার এন্ড পিস’ অবলম্বনে তৈরী ছায়াছবির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যেন এখানে। পরনের ভারী জ্যাকেট নিয়ে দৌড়াতে বেশ অসূবিধা দেখা দিল, ভাবলাম ছুড়ে ফেলি। কিন্তূ তখনই দেখলাম ভয়াবহ দৃশ্যটা, পাহাড়ের উচু হতে ধেয়ে আসছে অসংখ্য পাথর, সাথে ধনুক হতে ছোড়া শত শত তীর। জ্যাকেট ফেলে দেয়ার চিন্তাটা বাদ দিলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। পাগলের মত বেশ কিছুটা পথ দৌড়ানোর পর বুঝতে পারলাম তীর ধনুকের বলয় হতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি আমি। ওগুলো টার্গেট মিস করে লুটিয়ে পরছে পাথরের উপর, সাথে সৃষ্টি করছে এক ধরনের বন্য আওয়াজ। দৌড় থামানো গেলনা কারণ সামনে পেছনে সবাই এ কাজটা করছে জীবন বাজি রেখে। হঠাৎ মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, শ্বাষ নিতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে। থামতে বাধ্য হলাম। নাক হতে রক্তের ফোয়াড়া বইতে শুরু করেছে ততক্ষনে। সমুদ্র পৃষ্ট হতে প্রায় ৪০০০ ফুট উচুতে আমরা, এমন একটা উচ্চতায় কেনীয়ান দৌড়বিদরাও দু’বার চিন্তা করবে ম্যারাথন দৌড়ে শামিল হতে। প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। এক পা এগুনোর শক্তি অবিশিষ্ট নেই শরীরে। শুয়ে পরলাম বাধ্য হয়ে। জ্যাকেট্‌টা টেনেটুনে মরার মত পরে রইলাম কিছুক্ষন। দূরের চীলগুলোকে মনে হল আমার দিকেই তাকাচ্ছে যেন। চীল নয়, বড় বড় শকুন কোত্থেকে এসে হাজির, অনবরত চক্কর দিচ্ছে মাথার উপর। অনেক গল্প উপন্যাসে পড়েছি ক্ষুধার্ত শকুনের দল রক্তের গন্ধ পেলেই ছুটে আসে, খুবলে খায় খুজে পাওয়া শিকার। পাখীর শিকার হয়ে এন্ডিসের এ অঞ্চলে কংকাল হওয়ার ইচ্ছা হলনা, তাই জোড় করে দাড়াতে হল। আমার মত বিধ্বস্ত, বিপর্য্যস্ত এবং প্রায় অর্ধমৃত অনেক্‌কেই দেখলাম টেনেটুনে হাটছে। সবাই কম বেশী আহত, অনেকের নাক দিয়েই রক্ত ঝড়ছে। বেশ কিছুটা হেটে একটা বাক পার হতেই সামনের দৃশ্য দেখে বুকটা ছ্যাত করে উঠল। যতদূর চোখ যায় শুধূ মাঠ আর মাঠ। কোন এক দৈব মন্ত্রবলে হাওয়া হয়ে গেছে আমাদের বাস।

শুরু হল আসল চিন্তা। সাথে মানিব্যাগ ছাড়া অন্যকিছু নেই। পাসপোর্টটাও রেখে এসেছি বাসে। চিন্তার সব দুয়ার একসাথে বন্ধ হয়ে গেল যেন। কোথা হতে শুরু করব বুঝতে পারছিলামনা। মানিব্যাগ থাকলেও নগদ বলতে শ’খানেক ডলার, সাথে দু’টা ক্রেডিট কার্ড আর বলিভিয়ার কিছু বলিভিয়ানো। কিন্তূ এসব কাজে লাগিয়ে কি করে লোকালয় পর্য্যন্ত পৌছাবো তার কোন কাঠামো দাড় করাতে পারলামনা। এক কথায় আমি হারিয়ে দেছি এন্ডিস পর্বতমালার বাকে। মরে কংকাল হয়ে গেলেও কেউ আমার খোজ পাবেনা। মাথায় কোন কিছুই ঢুকতে চাইছেনা। বসে পরলাম ধপাস করে। নাকের রক্তটা থামানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হল হঠাৎ করে। সে সাথে থাকলে একটা কিছু বেরিয়ে আসত। কিন্তূ মাইলখানেকের ভেতর মেয়ে মানুষের কোন ছায়া দেখা গেলনা। কেন জানি মনে হল সে নিশ্চয় মিশে গেছে আদিবাসীদের সাথে। হয়ত তার মিশনটাই ছিল এখানে আসার এবং এই আউলা চক্কর কাছ হতে দেখার। মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাটতে শুরু করলাম। সামনে আরও একটা বাক। দেখতে হবে কি আছে ঐ বাকটার পর। গায়ের জোড় আর শরীরের জোড় একসাথে করে কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চল্‌লাম।

বাকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দু’এক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমান বাসগুলোকে। হঠাৎ মনে হল স্বপ্ন দেখছি না ত! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে উড়ছি আমি, সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া। জ্যাকেট্‌টা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউনা কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ, ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। আমার বিশ্রাম দরকার, সাড়া জীবনের বিশ্রাম। কিন্তূ বাতাসের শো শো আওয়াজ আর হাড্ডি কাপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাড়াল বাস এবং বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্য্যটাকেও কেমন ক্লান্ত মনে হল। কিন্তূ এ মুহুর্তে আমার ক্লান্ত হওয়া চলবেনা, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লীমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে আমায়।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন