এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ১১তম পর্ব

Submitted by WatchDog on Tuesday, October 13, 2009

Andes Mountains - South America

দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিষ্ফোরিত হল ট্যুর গাইড, সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পার। দু’একজন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা, বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভূলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘন্টায় ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাগুলো। পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফেরল, লাগেজ খুলে জায়গামত হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে, শুধু জীবন হতে খসে গেছে প্রায় ৩টা ঘন্টা। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিস্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা সত্বেও নামতে হল বাস হতে।

পরিস্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুল্‌ল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র, বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দু’এক জন যাত্রীর। বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হত বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত! এবার আমার প্রশ্ন করার পালা, ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে, কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাপলনা। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানষিকভাবে পংগু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে শান্তনা দিলাম।

আরও আধা ঘন্টা অপেক্ষা করল বাসটা, কিন্তূ ভিক্টোরিয়ার কোন হদিস পাওয়া গেলনা। আমাদের যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল, মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে, এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও সল্প সময়ে আমরা লা-পাস পোঁছ্‌তে পারব । আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না, লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে আমি নামছিনা। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষন সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো রহস্যের জন্মদিয়ে হারিয়ে গেল এন্ডিসের বাঁকে।

সামনের নড়বড়ে সেতুটা দেখে অন্তরাত্মা কেপে উঠল আমার। দৈত্যের তান্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভংগ করে। দূর হতে যতটা র্দুবল মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটা র্দুবল মনে হলনা সেতুটাকে। কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। টেনেটুনে শরীরটাকে কোন রকমে বাসে ঠেলে বসে পরলাম আগের সীট্‌টায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা।

চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষন। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরী্রের উপর। কতক্ষন ঘুমিয়েছি টের পাইনি, কিন্তূ চোখ খুলে জানালার বাইরে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সব ক্লান্তি। শুধু মাঠ আর মাঠ, মাঠের ঠিক মাঝখানটা ধরে চলে গেছে কাচা পাকা ট্রেইলটা। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত এন্ডিসের চূড়াগুলোর নৈসর্গিক প্যানোরমা, অন্যপাশে অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দু’একজন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে এন্ডিসের র্দুগম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা দেখে। নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খন্ড খন্ড জমিতে ভূট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চীল আর কায়োটির দল, এমন দৃশ্যও চোখে পরছে কিছুক্ষন পর পর। জানালার বাইরে সূর্য্যটাকে আগ্নেয়গীরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখাচ্ছে। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামন্য খুলতেই এন্ডিসের শো শো হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সীটে বসা অষ্ট্রেলিয়ায়ন স্বামী-স্ত্রী বীনিত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস, ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আট্‌কে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে, সামনে বিপদ!

আসলেই বিপদ, সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল বিনা বাক্য ব্যয়ে, কিন্তূ আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকা নিয়ে। কিছুক্ষন পর ট্যুর গাইড এসে জানাল চাইলে নীচে নামতে পারি। দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো ঝগ্‌টা ভেংগে গেছে ইতিমধ্যে! বাস হতে নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। নিজকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে,এবং হাত পাওয়ালা দু’একজন আদমকে দেখা গেল ঘুরাফেরা করতে। ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপূরী হতে নতুন একটা ঝগ আনবে বলে।

সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তূ কাংখিত সেই রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষনে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষন। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল, পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাষ্টবিনে ফেলা হয়নি। চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল, দু’টা বাসের সব যাত্রীদের ষ্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আর্ন্তজাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদকালীন সময়ের প্রস্তূতি হয়েই যেন ভ্রমনে বের হয়েছে। সবাই পেটপূরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমাব বলে। ১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া র্দুঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলিগামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল এন্ডিসের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষন করতে বাধ্য হয় অনেকেই। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্য্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখন্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লৌমহর্ষক জার্নির খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্য্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে? আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। প্রথমত আমরা এন্ডিসের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়, মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়, তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, - এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজের কাছে প্রমান করলাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।

শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। প্রায় সবারই অনেকগুলো দাঁত নেই, নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দারিদ্রতার সাথে রুক্ষ্ন প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে এন্ডিসের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যাবেনা। শত বছর বয়সী এক বৃদ্বার বেশ কটা ছবি তুল্‌লাম, সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে আসলাম বৃদ্বার আংগিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। পানি মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে কুয়াটায়, নিথর হীম শীতল ঠান্ডা! সময়টা মন্দ কাটলনা এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও। এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুল্‌ল বিরল মুহুর্তগুলো ধরে রাখবে বলে।

বাতাসের শো শো আওয়াজ আর ধোয়াটে আবহাওয়ার ফাক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এল স্বপ্নের সেই রাজপুত্র, হাতে বিশাল একটা ঝগ। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়াড়া বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।

-চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন