সকাল সকাল ঘুম ভেংগে গেল ওয়েক-আপ কল ছাড়াই। হাত ঘড়িটা বলছে স্থানীয় সময় সকাল ৬টা। খুব একটা বেশী সময় ঘুমিয়েছি বলে মনে হলনা। গতকালের ঘটনাগুলো এ মুহুর্তে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করলনা। এতদিন জেনেছি এক জায়গায় দু’বার বজ্রপাত হয়না, আজ বিশ্বাষ করতে ইচ্ছে হল আমারও পরপর দুটো দিন খারাপ যেতে পারেনা। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম ঘটনাবহুল আরও একটা দিনের প্রস্তূতি নিতে। মনে মনে দিনটার একটা ছক একে নিলাম; প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সময় মত পেরুর রাজধানী লিমা ফিরে যাওয়া, দ্বিতীয়ত, শহরটা দেখতে হবে যে কোন মূল্যে।
এধরনের সস্তা হোটেলে থাকার এ একটা ভাল দিক, বিনামূল্যে ব্রেকফাষ্ট! যদিও তা আহামরি কিছু নয়, কিন্তূ সময় মত হাতের কাছে পাওয়াটাই অনেককিছু, বিশেষকরে ডলার পাউন্ডের দেশে। ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে নামতে ৭টা বেজে গেল। টোষ্টেড রুটির উপর মাখন, সাথে ডিমের অমলেট, সবশেষে এক কাপ ধূমায়িত কফি, মন্দ না ফ্রি নাস্তার জন্যে। পকেটে পাসপোর্টটা আরও একবার পরীক্ষা করে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। রোববার সকাল, উত্তর আমেরিকার হিসাব মত সময়টা হওয়া চাই একেবারেই জনশূন্য। কিন্তূ এখানে দেখলাম ঠিক তার উল্টো, চারদিক লোকে লোকারন্য। হাটতে হাটতে হাজির হলাম রাতে যেখানটায় আমাকে বাস হতে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। ঢালু রাস্তা, হাটতে গেলে মনে হবে কেউ যেন পিছন হতে ধাক্কা মারছে, গড় গড় করে নেমে গেলাম উচ্চতা হতে। সান ফ্রান্সিসকো প্লাজায় দৃশ্যটা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল, হরেক রকম পোশাক পরে একদল বৃদ্ব-বৃদ্বা নাচ্ছে। বলিভিয়ানরা দৈর্ঘ্যে প্রায় সবাই ছোট, কিন্তূ প্রস্থে বেশ নাদুস নুদুস। বাদ্যযন্ত্র প্রায় সবার হাতে, ৩-৪ জন মিহিসুরে গান গাইছে। এ রকম প্রায় ৩/৪ গ্রুপে আলাদা হয়ে গোটা ৫০ মানুষ উপভোগ করছে রোববারের অলস সকাল। একজনকে জিজ্ঞাষ করে জানা গেল একটু পর এরা সবাই চার্চে যাবে, ঈশ্বরকে আগাম ধন্যবাদ জানাতে এই আয়োজন। বিভিন্ন এংগেল হতে বেশ ক’টা ছবি তুল্লাম। আমার মত বেশ ক’জন ট্যুরিষ্টকেও দেখলাম প্রাণভরে উপভোগ করছে সকালের এই আয়োজন। ৮টা বাজতেই হুস হল, ফিরে যাওয়ার টিকেট কেনা হয়নি এখনো।
মাথা ঠান্ডা রেখে প্ল্যান শুরু করলাম কোথা হতে শুরু করা যায়। কিছুদূর না যেতেই দেখা মিল্ল স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনটার। দৈব জিনিষে বিশ্বাষ ছিলনা কোন কালেই, কিন্তূ এ যাত্রায় মনে হলে দিনটা ভাল যাওয়ার এ যেন ঐশ্বরিক ইংগিত। সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে পরলাম। ‘উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?‘ দাঁড়াও বলে ভেতরে গিয়ে নিয়ে আসল ইংরেজী জানা এক মহিলা পুলিশকে। খুলে বল্লাম আমার কাহিনী। উত্তরে ভদ্রমহিলা যা বল্ল তাতে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলামনা। আজ রোববার, খাবার দোকান ছাড়া লা পাজ শহরের সবকিছু বন্ধ! গতকালের মত সবকিছুতেই আতংকিত না হয়ে জানতে চাইলাম কোথা গেলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য মিলতে পারে। ফাইভ ষ্টার হোটেল হতে পারে পার্ফেক্ট স্পট, এমনটাই ধারণা পাওয়া গেল পুলিশ ষ্টেশনে। তথাস্তূ! সব দ্বিধা দন্ধ আছড়ে ফেলে লম্বা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম ফাইভ ষ্টার হোটেলের খোঁজে। আন্ডিসের মৃদু মন্দ বাতাসে হাটতে মন্দ লাগছিলনা, এক ধরনের কাব্যিক আনন্দ পেলাম সুমুদ্রপৃষ্ট হতে এতটা উচ্চতায় ঘুরে বেড়াতে। না, কোন কিছুতেই আজ মন খারাপ হচ্ছেনা। দূর হতে পড়তে অসূবিধা হলনা দালানটার মাথায় সাইনবোর্ডটা, র্যাডিশন। ভেতরে ঢুকতেই ফাইভ ষ্টার আরামের গন্ধ পাওয়া গেল চারদিকে। হোটেলটার নিজস্ব ট্রাভেল এজেন্জিটাতে বড় একটা তালা ঝুলতে দেখে মনটা বেশ দমে গেল। ফ্রন্ট ডেস্কে আলাপ করে জানা গেল সোমবার সকাল ছাড়া কাজ হবেনা। নিজের কাহিনী সবটা খুলে বলতে ডেস্কে বসা ল্যাটিন সুন্দরীর মন গলাতে পেরেছি মনে হল। মুহুর্তের মধ্যে গোটা দশেক ফোন করে গাই গুই করে স্প্যনিশ ভাষায় কি বল্ল কিছুই বুঝা গেলনা। কিন্তূ কাজের কাজ হল শেষ পর্য্যন্ত। ’লান চিলি’ নামের এয়ার লাইনের টিকেট পাওয়া গেল, দাম নিয়মিত দামের প্রায় ৩ গুন। আলহামদুল্লিলাহ্ বলে জবাই হওয়ার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হলাম। সকাল ৭ টার ফ্লাইট, এয়ারপোর্ট থাকতে হবে ৬টার ভেতর। সুন্দরী জানাল সোমবার সকালে নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘট। মন মনে বল্লাম, লা ক্যুম দ্বিনুকুম ওলয়্যাদিন ...। আমাকে আর পাচ্ছনা তোমরা! টিকেটের ঝামেলা শেষ হতেই মনে হল গোটা এন্ডিস পাহাড় নেমে গেছে মাথা হতে। এবার যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা তা পূর্ণ করার পালা। এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলাম ফ্রন্ট ডেস্কের কাছেই। তোতা পাখীর মত একগাদা ট্যুরের আমলনামা ধরিয়ে দিল হাতে। ধারণাটা হঠাৎ করেই মাথায় খেলল, প্রথমবার সিংগাপুর গিয়েও এর সাহায্য নিয়েছিলাম। সাড়াদিনের জন্যে বিশ্বাষযোগ্য একজন ক্যাব ড্রাইভার দরকার আমার, জানাতেই বত্রিশ পাটি দাঁত উদাম করে হেসে উঠল উদ্বার দেবী। হোটেলের নিজস্ব ড্রাইভার কার্লোস বসে আছে ৭ দিন ধরে, হাংগামার কারণে ট্যুরিষ্টদের দেখা নেই, আমই চাইলেই নিতে পারি তাকে। ৬০ ডলারে ফয়সালা হয়ে গেল। সেকেন্ডের ভেতর মাটি ফুড়ে হাজির হলেন আমার সাড়াদিনের কেনা গোলাম কার্লোস হেরনান্ডেস।
শুরু হল এন্ডিস পর্বত মালা বিচরনের শেষ পর্ব!
- চলবে
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১ম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ২য় পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৩য় পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৪র্থ পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৫ম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৬ষ্ঠ পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৭ম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৮ম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ৯ম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১০ম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১১তম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১২তম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১৩তম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১৪তম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১৫তম পর্ব
- এন্ডিস পর্বতমালার বাকে বাকে - ১৬তম (শেষ) পর্ব