নিউ ইয়র্কে বাস করার সময় একজনকে উপকারের জন্যে কিছু মিথ্যা বলতে হয়েছিল। বাংলাদেশে সে আমার নিকট প্রতিবেশী, নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করছে প্রায় ২০ বছর। অভিবাসন প্রক্রিয়ার গ্যাড়াকলে আটকে গিয়ে বেচারা দেশে যেতে পারছেনা অনেক বছর। কাঁদো কাঁদো চেহারায় আমার উডসাইডের এপার্টমেন্টে হাজির হয়ে জানাল ১ মাস পর ইমিগ্রেশন কোর্টে শুনানি, সাহায্য দরকার তার। এসব ভেজালে জড়াতে মন চায়না, কিন্তূ না চাইলেও এ যাত্রায় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিলনা, কারণ দেশে তার মা-বাবা আমাদের পারিবারিক বন্ধু। বানোয়াট একটা কাহিনী বানাতে হবে আমাকে, যেখানে থাকতে হবে উল্লেখিত চরিত্র রোমিও এরশাদ হোসেনের জাতীয় পার্টির সদস্য এবং দেশে যেতে পারছেনা ক্ষমতাসীন দলের প্রতিহিংসার কারণে (বিএনপি ছিল ক্ষমতায়)। ঢাহা মিথ্যা তথ্য, কিন্তূ উপায় নেই অনুরোধ উপেক্ষা করার। দেশে কেউ তার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ন নয়, দস্তূরমত ধনী পরিবারের সন্তান এবং রাজনীতির রা শব্দের সাথেও তার পরিচিতি নেই। লেখাপড়া হয়নি বিশেষ কিছু, অল্প বয়সে জড়িয়ে যায় ফেন্সিডিল, ড্রাগ এবং পতিতালয় যাতায়াত সহ হরেক রকম কুকীর্তিতে। সামাজিক এবং আর্থিকভাবে তার বাবা যতই উপরে উঠ্ছে পাশাপাশি বেড়ে চল্ছে তার অপরাধপ্রবনতা, এমন একটা প্রেক্ষাপটে পরিবারের মান সন্মান বাচানোর চাহিদা হতে বখে যাওয়া ছেলেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সুদূর আমেরিকায়। হাফ ছেড়ে বাঁচে মা-বাবা এবং সমাজও মুক্তি পায় তার মত অপ্রয়োজনীয় এলিমেন্ট হতে।
মোহম্মদ ইরফান পেনসেলভেনিয়া অংগরাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরের বাসিন্দা। দু’মুঠো আহারের সন্ধানে দেশে এমন কোন ধান্ধা নেই যা তাকে করতে হয়নি। জাহাজের কুক হিসাবে চাক্রী করেছে অনেকদিন। সে জাহাজ নিউ জার্সির এলিজাবেথ বন্দরে নোঙর করতেই ইরফান হাওয়া হয়ে যায় মার্কিন দেশে। আমার সুপরিচিত রহমান ভাই, সিরাজগঞ্জ বিএনপির কোন এক প্রতিমন্ত্রীর সাগরেদ হয়ে মার্ডার, ব্ল্যাক মেইলিং সহ রাজনীতির তাবদ অন্ধকার গলি ঘুরে শেষ পর্য্যন্ত ঠাই নিয়েছেন নিউ ইয়র্কে। আজকের খবরে দেখলাম লিবিয়ায় ৫ হাজার বাংলাদেশী দালালের খপ্পরে পরে বেচে থাকার মানবেতর লড়াই করছে। স্বদেশী এক বামপন্থী নেতা উনার ট্রাডিশনাল ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের গুষ্টি উদ্বার করছিলেন ঘরোয়া এক আসরে; সাম্রাজ্যবাদ, পূঁজিবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ, সর্বহারাদের বিপ্লব, এ জাতীয় ভাষায় লেকচার দিয়ে শ্রোতাদের রক্তে স্ফুলিংগ বইয়ে দিচ্ছিলেন বিনা বাধায়। আসর শেষ হতেই চেপে ধরলাম, একটা প্রশ্নের উত্তর চাই আমার, আগামীকাল মার্কিন ইমিগ্রেশন যদি ঢাকায় শতাধিক বোয়িং ৭৪৭ পাঠিয়ে ঘোষনা দেয় ’আগে এলে আগে পাওয়া যাবে’ ভিত্তিতে ৫ লাখ বাংলাদেশীকে অভিবাসনের সূযোগ দেয়া হবে, আপনি কি সামিল হবেন সে দৌড়ে? এর উত্তর কি হতে পারে তা আমাদের সকলেরই জানা। এক কথায়, জল, স্থল এবং অন্তরীক্ষ হয়ে বৈধ অবৈধ পথে প্রতিদিন শত শত বাংলাদেশী পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে ভাগ্যের সন্ধানে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার প্রকারভেদ সত্ত্বেও সম্ভব হলে বাংলাদেশের প্রায় ১৫ কোটি মানুষই বিদেশ পাড়ি দিতে প্রস্তূত, একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে কেন এমনটা হচ্ছে আসুন তার একটা সারমর্ম দাড় করানোর চেষ্টা করি।
একজন অসাধু ব্যবসায়ী, একজন র্দুনীতিবাজ রাজনীতিবিদ, প্রতিষ্ঠিত আমলা সহ দেশের এলিট অংশ কেন বিদেশে পাড়ি জমাতে চায় তা নিয়ে রয়েছে বহুমূখী বিতর্ক। আমার দৃষ্টিতে এক বাক্যে এ প্রশ্নের উত্তর হতে পারে বছরখানেক আগে বিদায় নেয়া তত্ত্ববধায়ক সরকার। এক কথায়, অনিশ্চয়তা! সমাজের সর্বক্ষেত্রে রাজত্ব করছে অনিশ্চয়তা, যা ব্যহত করছে আগামী দিনের বেঁচে থাকা। কৃষক নিশ্চিত হতে পারছেনা জমির ফসল নিয়ে, কারণ নিশ্চয়তা নেই সার, পানি, বিদ্যুৎ এবং সময় মত দেনা পরিশোধের। ব্যবসায়ী কোটি টাকা আয় করেও নিশ্চিত হতে পারছেনা এ টাকার স্থায়িত্ব নিয়ে। অনিশ্চয়তার নাভিশ্বাষে চাক্রীজীবির প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেশীয় লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত মা-বাবা, তাই গাটের শেষ পয়সা ব্যায় করে সন্তানকে বিদেশে পাঠাতে সামান্যতম চিন্তা করছেনা। দেশের নন-প্রোডাক্টিভ উচ্চ শিক্ষা যুব সমাজকে না পারছে চাক্রীতে ঠাই দিতে, না পারছে শারীরিক পরিশ্রমের দিকে টানতে। ফলশ্রুতিতে জন্ম নিচ্ছে হতাশা এবং এ হতাশা সৃষ্টি করছে বহুমূখী নৈরাজ্যের। এ সমস্যার রেডিমেইড সমাধান হিসাবে আলেয়ার মত হাতছানি দেয় বিদেশ। বসত বাড়ি বিক্রী করেও বিদেশ ছুটছে যুব সমাজ। প্রতারিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করার সম্ভাবনা রয়ে গেছে, এমনটা জেনেও হাজার হাজার যুবক তৈরী হচ্ছে ডিংগী করে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার, পায়ে হেটে সাহারা মরুভূমি জয় করার। পৃথিবীর দেশে দেশে বাংলাদেশীরা মরছে পশু পাখীর মত, অনেক স্বদেশীর লাশ খুবলে নিচ্ছে কায়োটির দল। কিন্তূ দুঃখজনক হলেও কমছেনা বিদেশের হাতছানি।
দেশ হতে দেশান্তর হওয়া সভ্যতা বিবর্তনের অংশ, এ ভাবেই গড়ে উঠছে বিভিন্ন জাতি, সমাজ, দেশ এবং মহাদেশ। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে আমাদের সমাজে এ বিবর্তনের ধারাটা একটু ভিন্নমূখী। ঐতিহাসিক ভাবে আমরা খুব বেশী সামাজিক এবং পারিবারিক জাতি। কিন্তূ আমাদের চলমান রাজনীতি এ দেশের ঘরে ঘরে বিভক্তির যে ভয়কংকর বীজ বপন করছে তার ফসল আমরা ঘরে তুলছি প্রতিদিন। এই রাজনীতি ব্যর্থ হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং শিক্ষার মত মৌলিক সমস্যাগুলো এড্রেস করতে। পাশাপাশি জনসংখ্যার বিস্ফোরন সৃষ্টি করছে এমন সব অদেখা সমস্যা, যার সাথে বাইরের দুনিয়ার বিশেষ কোন পরিচয় নেই।
একটা বাস্তবতা অনুধাবন করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি, মানব সম্পদ রফতানীর উপর একটা দেশের অর্থনৈতিক চাকা সাময়িকভাবে ঘুরলেও এর উপর ভিত্তিকরে ভবিষৎ দাড় করানো যায়না। মধ্যপ্রাচ্যে ফুরিয়ে আসছে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, ইউরোপ এবং আমেরিকা ধুকছে অর্থনৈতিক মন্দায়। সেদিন খুব একটা বেশী দূর নয় যেদিন লাখ লাখ বাংলাদেশীকে দেশে ফিরতে হবে এক কলমের খোচায়। কি হবে তখন আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি? বাংলাদেশের মালিকানা নিয়ে দুই পরিবারের বিবাদকে চীরস্থায়ী কবর না দেয়া গেলে আগামী ৫০ বছরের ভেতর দেশে শুধু দুই পরিবারের লড়াই নয়, বরং ঘরে ঘরে শুরু হবে লড়াই, মাথার উপর ছাদ নিশ্চিত করার লড়াই, দু’বেলা দু’মুঠো আহারের লড়াই। এক কথায় হাতাহাতি, পারিবারিক লড়াই।