চারদিকে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে গেল গোলান্দাজ, জায়গাটা একেবারেই অপরিচিত মনে হল তার। সাদা দেয়াল, লম্বা লম্বা জানালার উপর ধবধবে সাদা পর্দা, এমনকি ঝুলন্ত ফ্যানগুলোও কেমন যেন অতিরিক্ত সাদা মনে হল তার কাছে। বিশাল আকৃতির রুমটায় নিজের খাট্টা ছাড়াও আরও বেশ ক’টা সরু লোহার খাট দেখে মনটা বেশ দমে গেল তার। ভাবনাটা অজান্তেই মগজে এসে চেপে বসল, নিশ্চয় ইহ জগৎ শেষে পরজগতে চলে এসেছে সে! স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে বেশ ক’বছর মাদ্রাসায় পড়তে হয়েছিল তাকে, বছরুদ্দিন হুজুর বেহেশতের এমন একটা ছবির কথাই ইনিয়ে বিনিয়ে হাজার বার বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তূ তার মত আজন্ম পাপী কেন বেহেস্তে ঠাই পাবে তার কোন কুল কিনারা করতে পারলনা গোলান্দাজ। খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হতেই শীড়দাড়া বেয়ে এক ধরনের ঠান্ডা হাওয়া নেমে গেল, নিশ্চয় ফেরেশতাদের কেউ একজন আসছেন! ফেরেশতার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ছূরাটা মনে করার চেষ্টা করল সে। গায়ে চিমটি কাটল গোলান্দাজ, স্বপ্ন দেখছে না ত? মউতি ফেরেস্তার আগে হুরপরীর দেখা মিলবে এমন তথ্য বছরুদ্দিন কেন ওলামা লীগ প্রধানের বয়ানে ছিল এমনটা মনে করতে পারলনা সে। অতি সংক্ষিপ্ত সাদা পোশাক, কোরবানী ছুড়ির মত ধারালো শরীর আর গায়ে গতরে বংগোপসাগরের ঢেউ তুলে কেউ একজন নিঃশব্দে এগিয়ে এল গোলান্দাজের বিছানার দিকে। হূৎপিন্ডের দাপাদাপিটা কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারলনা সে, রুমের প্রচন্ড ঠান্ডায়ও ঘাঁমতে শুরু করল গোলান্দাজ।
- শুভ সকাল মিঃ বেপারী, ভিল্লাপাল্লাই রিসার্চ & প্রটেকশন সেন্টারে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি, আমি রত্মাবাঈ ভিল্লাপাল্লাই। এ মুহুর্তে আপনি যা ভাবছেন তা সত্য নয়, আপনি ইহ জগতেই আছেন এবং আমিও হুরপরী নই।
কয়েক সেকেন্ড কথা ফুটলনা গোলান্দাজের মুখে, একসাথে এতগুলো বিস্ময় সামলানোর মত শক্তি শরীরে অবশিষ্ট ছিলনা তার। ‘আমি কোথায় মিস ভিল্লাপাল্লাই?‘ - বিড়বিড় করে জিজ্ঞেষ করল।
- এ নিয়ে এখন আর কোন কথা নয়। চাইলে বিছানা ছাড়তে পারেন, আপনি এখন পুরোপুরি এন্টিডোট মুক্ত। লাঞ্চের পর কনফারেনস্ রুমে আসবেন, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর তৈরী থাকবে। ও হ্যাঁ, হলরুমে পরিচিত অনেকের দেখা পাবেন, চাইলে এখনই যেতে পারেন ওখানটায়।
হাই হীল জুতার কট কট আওয়াজ আর নিতম্বে এলোমেলো ঢেউ তুলে যে পথে এসেছিল সে পথেই মিলিয়ে গেল সফেদ সুন্দরী। মুগদ্ব চোখে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল গোলান্দাজ।
’রত্মাবাঈ ভিল্লাপাল্লাই!‘, চোয়ালটা শক্ত করে লোভাতুর কণ্ঠে উচ্চারন করল গোলান্দাজ। হেড অফিসে ফোন করলেই সব খবর বেরিয়ে আসবে ভাবতেই চক চক করে উঠল চোখ মুখ। এদিক ওদিক ফোনের সন্ধান করল সে, না পেয়ে হতাশ হল এবং এমন একটা সফিসটেকেটেড জায়গায় ফোন না থাকায় ক্ষুদ্ব হল মনে মনে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, পরনের কাপড়টা ঠিক করে বেরিয়ে পরল হলরুমের সন্ধানে।
ওসমান গনির দেখা মিলল কড়িডোরে, তিনিও হলরুমের দিকে যাচ্ছেন একই উদ্দেশ্যে। বনখেকো ওসমান গনি এখানে কি উদ্দেশ্যে তার কোন সূত্র আবিস্কার করতে ব্যর্থ হল গোলান্দাজ। দলীয় সহনেত্রী সাজেদা চৌধুরীর পেট ও পকেট ভারী করতে গিয়ে বেচারাকে জেল হাজত পর্য্যন্ত হজম করতে হয়েছে, অথচ বেগম চৌধূরী এবং তার ছেলে সাদাব চৌধূরী গায়ে গতরে বাতাস লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাবতেই ওসমান গনির প্রতি একধরনের বোবা সহানুভূতি জন্মাল গোলান্দাজের মনে। হলরুমে ঢুকে বাকিদের দেখে সব চিন্তা নিমিষে দূর হয়ে গেল তার, পুরানো ইয়ার দোস্তদের দেখে উচ্ছাসে ভেসে গেল সে। সালমান এফ রহমান, চট্রগ্রামের আখতারুজ্জামান বাবু, ঢাকার ডাঃ এবিএইচ ইকবাল, চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিন, ফেনীর জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান সহ পরচিত অপরিচিত অনেক মূখ দেখে নিজকে সহসাই আবিস্কার করে ফেল্ল গোলান্দাজ। বাকীদের খুব একটা উচ্ছা্সিত না দেখে একটু দমে গেল সে। কোথায় যেন কি একটা গোলমাল চলছে, চিন্তাটা ভাবিয়ে তুল্ল তাকে।
’আরে মহিউদ্দিন ভাই যে, আছেন কিমুন?’- পার্টিসূরে প্রথম প্রশ্নটা ছূড়ে দিল মেয়রের দিকে। ’আর কইয়েন্না আন্দাজ ভাই, চাঁটাগাইয়্যা এমপিগো লইয়্যা বহুত মুসিবতে আছি, কথায় কথায় ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ হয়ে গেছে হারামীর বাচ্চারা, তাছাড়া টিভি চ্যানেলটা চালু রাখার মূলধন যোগাতে গিয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা’- গোস্বা মূখে জবাব দিল মেয়র মহিউদ্দিন। মনে মনে প্রমাদ গুনল গোলান্দাজ, দুই মাস আগে সিটি কর্পোরেশনের টেন্ডারে নগদ ১৩ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে মেয়রকে। ‘শালা শিং মাছের মত পিছলা মিথ্যুক‘ - মনে মনে ভাবল গোলান্দাজ। ’ভাইব্যেন্না বেয়াই সাব, সব সমস্যা দূর হইয়া যাইব ইনশাল্লাহ্’, তোতা পাখীর মত মুখস্ত বুলি আউড়ে গেল সে। সালমান এফ রহমান এগিয়ে এল হাত বাড়িয়ে, ‘আন্দাজী ভাই, হাউ ডু ইউ ডু?। একে একে সবার সাথে কুশল বিনময় করে হাপিয়ে উঠল গোলান্দাজ। ক্লান্তিতে বসে পরল পাশের সোফাটায়।
রত্মাবাঈ ভিল্লাপাল্লাইকে এগিয়ে আসতে দেখে ফিসফাস সহসাই থেমে গেল। ভেতরে ভেতরে সবাইকে কেমন উত্তেজিত মনে হল।
- জেন্টেলম্যান, আরাম করে বসুন, কোম্পানীর সিইও জনাব রামগোপাল ভিল্লাপাল্লাই কথা বলবেন আপনাদের সাথে ।
- আমাদের আটকে রাখা হয়েছে কেন? ষড়যন্ত্র করে বংগবন্ধুর স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করতে পারবেনা স্বাধীনতা বিরোধীরা, আমরা আবারও রাজপথে ফিরে যাব, আন্দোলনে অচল করে সমগ্র দেশ‘, - রাগে ফেটে পরল নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান। খান বাহাদুর ওসমান পরিবারের এই সদস্যকে ভীষন ভয় পায় গোলান্দাজ, টাকার দাবীতে কথায় কথায় পিস্তল ধরতে দ্বিধা করেনা রক্ত গরম এই নেতা। এক বছরও হয়নি দল ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে অথচ ইতিমধ্যে ওসমান পরিবারকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে গোলান্দাজ এন্ড এসোসিয়েট্স্কে, তাও আবার বিদেশী ব্যাংকে। কথাটা মনে হতে মুচকি হাসল গোলান্দাজ, নেতা নামের এই জংগীকে হাজার বছর আটকে রাখলেও তার বলার কিছু থাকবেনা! ওসমান গনী এবং মেয়র মহিউদ্দিনকে দেখা গেল কানে কানে কি যেন ফয়সালা করতে। ’নিশ্চয় নতুন কোন চাঁদা’ - আবারও কষ্ট পেল ওসমান গনীর জন্যে।
’জেন্টেলম্যান, আপনাদের একটা জিনিষ মনে করিয়ে দিতে চাই, এটা ২০৫৯ সাল, আপনাদের ট্রাডিশনাল রাজনীতি এবং তার নেতা নেত্রীর মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে, রক্ত গরম করে লাভ নেই, বরং ঠান্ডা হয়ে বসুন এবং উত্তরের জন্যে অপেক্ষায় করুন ভিল্লাপাল্লাইজীর।’ রত্নাবাঈয়ের মিষ্টি আওয়াজে পীন পতন নীরবতা নেমে এল হলরুমে। বিস্ময়ে থ হয়ে গেল গোলান্দাজ, ছানাবড়া চোখ দু'টো কোটারা হতে বেরিয়ে আসতে চাইল বিনা নোটিশে! মনে হল জ্ঞান হারাচ্ছে সে।
- চলবে