লেখাটার মূল পর্বে যাওয়ার আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সূত্র টানতে চাই। আশির দশকের শেষ ভাগের কথা, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় লেখাপড়া করছি। ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনীয়ারিং’এ মাষ্টার্স পর্বে ফাইনাল থিসিস লিখছি। স্থানীয় বিদুৎ সরবরাহ সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী আমার গাইড। গৎবাধা সিকিউরিটি চেক শেষে সুন্দর এক সকালে হাজির হলাম গাইডের মূল কার্য্যালয়ে। টিপিক্যাল রুশ চেহারার নাদুস নুদুস চেহারার (ভদ্কা খোর) একজনের কাছে পরিচয় দিতেই উৎফুল্ল হয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। আমিও অভিভূত হলাম ভদ্রলোকের আন্তরিকতায়। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই গাইড জানতে চাইলেন আমার ব্যকগ্রাউন্ড, অর্থাৎ আমি কোন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশের নাম শুনতেই চেয়ার হতে লাফিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। জানা গেল ভদ্রলোক কর্ম উপলক্ষে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দু’টা বছর কাটিয়েছেন এবং শত শত সৃত্মি নিয়ে জীবনের বাকি দিন কাটাচ্ছেন। মুহুর্তের মধ্যে গাইড-ছাত্র সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুত্বের পর্য্যায়ে চলে গেল।
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ নিয়ে। প্রাসঙ্গিকভাবে বসের কাছে জানতে চাইলাম বাংলাদেশে অবস্থানকালে মনে রাখার মত সৃত্মির কথা। একটা মিনিট চুপ করে ভদ্রলোক বর্ণনা করে গেলেন স্বচক্ষে দেখা একটা অভিজ্ঞতার কথা। কোরবানীর ঈদ! পাঞ্জাবীর আস্তিন ঘুটানো শুভ্র দাড়িওয়ালা এক হুজুর, হাতে খোলা এবং রক্তাক্ত তরবারী। বিদ্যুৎ গতিতে একস্থান হতে অন্যস্থানে দৌড়াচ্ছে, ঝাপিয়ে পড়ে জবাই করছে একটার পর একটা অসহায় পশু। রক্তের ফিনকিতে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ, সামান্য দূরে দাড়িয়ে শিশুরা আনন্দে হাত তালি দিচ্ছে। গাইড জানালেন এমন একটা অনুষ্ঠান সম্পর্কে পূর্ব ধারণা না থাকার কারণে তিনি মুষড়ে পরনে, তার ৯ এবং ৪ বছর বয়স্ক দুই সন্তান জ্ঞান হারিয়ে জরুরী ম্যাডিকেল সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। ঘটনার দিন হতে ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তার কন্যাদ্বয় মাঝে মধ্যে ঘুমের ঘোরে চীৎকার করে উঠে। শেষ পর্য্যন্ত মানষিক রোগের চিকিৎসা নিতে বাধ্য করেন তাদের, কিন্তূ তাতেও না-কি পূরোপুরি কাজ হয়নি।
দুদিন পর আরও একটি ঈদ পর্ব উৎযাপনের জন্যে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে একত্রিত হবে, কোরাবানীর ঈদ! বিশেষ করে বাংলাদেশে এ উৎসব ঘরে ঘরে নিয়ে আসবে উৎসবের আমজে। হাজার বছরের ঐতিয্য এবং ধর্মীয় অনুশাষনের ধারা রক্ষা করতে গিয়ে আবারও আমরা জবাই করব লাখ লাখ পশু। সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য প্রমানের জন্যে হাজার বছর আগে ইব্রাহিম (আঃ) নিজ সন্তানকে কোরবানী করতে প্রস্তূত ছিলেন, সৃষ্টিকর্তা সন্তূষ্ট হয়ে সন্তানের বদলে পশু কোরবানীর আদেশ দিলে সূত্রপাত হয় কোরবানী ঐতিয্য। আজকে একবিংশ শতাব্দিতে কোরবানী কোন আনুগত্যের মাইলষ্টোন হয়ে কাজ করছে তার পক্ষে পন্ডিতদের নিশ্চয় হাজারটা বক্তব্য থাকবে। আমারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব সমসাময়িক কুরবানী ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হচ্ছে? সমাজের একাংশে কুরবানীকে ব্যবহার করা হচ্ছে নিজদের অবৈধ বিত্ত বৈভব্যের নগ্ন প্রদশর্নী হিসাবে, আরেক অংশের জন্যে তা হচ্ছে নিজদের সামর্থের সীমা অতিক্রম করে সামাজিকতা রক্ষা করা। কোরবানী এলেই বেড়ে যাচ্ছে ডিপ-ফ্রীজের বিক্রী, বাড়ছে মাংস সংরক্ষনের বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন। প্রদশর্নীর দৌড়ে জয়ী সমাজপতিদের অনেক্কেই দেখা যায় দিন শেষে কুরবানির আস্ত গরুটাই সাইজ করে ডীপ ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখতে। উচ্ছিষ্ট কিছু বিতরনের ঐতিয্য এখনো যে মিলিয়ে যায়নি তা বলা যাবেনা, কিন্তূ সামগ্রিক হিসাবে এ সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। কুরবানীর প্রথম প্রহরে কেবল মাত্র জবাইকারীর মুখে শোনা যায় ধর্মের যূগসূত্রতা, বাকি সময়রে যে কোন ধাপেই ধর্মীয় মূল্যবোধের রেশ থাকে অনুপুস্থিত। এ ধরনের গন জবাই একদিকে আমাদের লাইভ ষ্টকের সংখ্যাকে বিপদজনক সংখ্যায় নামিয়ে আনছে, পাশাপাশি অতিরিক্ত লাল-মাংস ভক্ষন জনস্বাস্থ্যের জন্যে বয়ে আনছে মানব সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত হুমকি। প্রাসংগিক কারণে পরিবেশ দূষনের ভয়াবহতা নাই বা টানলাম। জানি অনেকের কাছে এ লেখা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত মনে হতে পারে, কিন্তূ অনুরোধ করব জিনিষটাকে দেশীয় আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার আলোকে বিচার করতে। রাতারাতি কুরবানি বন্ধ করতে হবে এমন হেদায়েত আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়, বরং কুরবানীকে কম্যুনিটি নিয়ন্ত্রিত একটি সামাজিক অনুষ্ঠান হিসাবে নিলে উপরের সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি ধর্মীয় দিকটাও সমুন্নত রাখা যাবে ব্যাপক অর্থে। হতে পারে তা ওয়ার্ড ভিত্তিক, পাড়া ভিত্তিক অথবা মসজিদ কেন্দ্রিক। কেবল মাত্র সক্ষম ব্যক্তিদের কন্ট্রিবিউশনে গঠন করা যেতে পারে কুরাবানী ফান্ড যার লিমিট নির্ধারিত হবে এর সদস্য এবং পরিবারে মাথা হিসাবে। কুরবানীর ঈদ তিন দিন প্রলম্বিত হয়, মাংসের পরিমানও এ তিন দিনের জন্যে নির্ধারিত থাকতে পারে। ফান্ড সদস্যদের চাহিদা মেটানোর পর কুরবানীর বাকি অংশ জমা হতে পারে শহর ফান্ডে যার বেনিফিশিয়ারী হবে গরীব এবং দূস্থরা। কুরবানী একটা নিস্কাষন বান্ধব জায়গায় সমাধা করলে পারিবেশ বিপর্য্যয় হতে রক্ষা পাবে আমাদের লোকালয়।
জানি আমার এ ধারণায় অনেক ফাক ফোকর পাওয়া যাবে যা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে পারে। কিন্তূ অপরিকল্পিত কুরবানী যে একটা আর্থ-সামাজিক সমস্যা তা শিকার করলে আমার এ লেখা সার্থক হবে।