ঢাকা সিলেট রোডের পুরিন্দা বাজার হতে মাইল খানেক আগেই অবস্থার ভয়াবহতা ফুটে উঠল। পাঁকা রাস্তার আসফালট্ উঠিয়ে বড় বড় গর্ত করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ট্রাফিক চলাচল। টায়ার পুড়ছে ইতস্তত এবং এর ধোঁয়া বহুদূর হতে দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু গাড়ি, বাস, ট্রাক, টেম্পু ভাংগা হয়ে গেছে, উন্মত্ত জনতা লাঠিসোঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে নতুন ভাংচুরের আশায়। প্রথম ধাক্কায় মনে হতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের উপর ছায়াছবি চিত্রায়িত হচ্ছে হয়ত! আসল ঘটনা জানা গেল কিছুটা সামনে গিয়ে। বিএনপির বড় মাপের এক নেতা দলীয় মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়েছেন, নিবেদিত কর্মীরা কিছুতেই মানতে পারছেনা এই ‘পরাজয়‘। ডাক্তারদের কথা; মনের রাগ মনে রাখলে তা শরীরের জন্যে খারাপ, রক্তচাপ এবং হার্টের উপর আঘাত আসতে পারে! কর্মীদের হয়ত এ সত্যটা ভাল করে জানা ছিল, তাই রাগ ভেতরে না রেখে উজার করে ঝেড়ে দেন ঢাকা-সিলেট রোডের উপর। সকাল ১০টা হতে শুরু এই তান্ডব, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ এমব্যুশ শেষ হচ্ছেনা কিছুতেই। দু’একটা পুলিশের গাড়ি পুরিন্দা বাজারে ঠায় হয়ে দাড়িয়ে আছে, পুলিশ ভাইরা চা-পানি খাচ্ছে আর খোশ গল্পে মাতিয়ে রাখছে এমবুশকারীদের। হাল ছেড়ে দিয়ে আমিও যোগ দিলাম কর্মীদের সাথে, উদ্দেশ্য ঘটনাটার বিস্তারিত জানা।
জনাব রোকনুদ্দিন মোল্লা শুধু বিএনপির প্রথম সাড়ির নেতাই নন, তিনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি। আর,এম শিল্পগুষ্টির মালিক। পুরিন্দা বাজার হতে মাধবদীর দিকে গেলে মধ্য পথেই চোখে পরবে উটমার্কা ঢেউ টিনের বিশাল শিল্প এলাকাটা। উঁচু দেয়াল আর কাটা তারের বেড়া দিয়ে প্রকৃতির এক নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরী করা হয়েছে এর অভ্যন্তরে। এত বড় আলীশান শিল্পের মালিককে মনোনয়ন না দিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে কোথাকার কোন আংগুর না বেদানা সাহেবকে। মোল্লা সাহেব মেনে নিতে পারেন্নি এই অপমান, তাই কারখানার শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে নামিয়ে দিয়েছেন রাস্তায়। শ্রমিকরাও এই অপ্রত্যাশিত ছুটিতে আনন্দিত, এবং প্রতিদান হিসাবে মোল্লা সাহেবকে উপহার দিয়েছেন আন্তজেলা হাইওয়ে অবরোধ। থেমে থাকা বাসযাত্রীদের বুঝানো হল ঢাকা হতে বিএনপির বড়মাপের কেউ একজন আসছেন মোল্লা সাহেবের জনপ্রিয়তা নিজ চোখে দেখতে।
রোকনুদ্দিন মোল্লা, নামটা ঐ এলাকায় অপরিচত কোন নাম নয়। যদিও ১৯৭১ সালের আগে ভদ্রলোক রতন মোল্লা নামেই পরিচিত ছিলেন। এলাকার লোকজনের মতে মাধবদীর গরুর হাট অথবা বাবুরহাট এলাকায় বেচারা ঘুর ঘুর করতেন অন্য এক ধান্ধায়। অল্প বয়স হতেই বেশ ভাল হাডুডু খেলতে জানতেন। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে হাডুডু খেলার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি, উৎসব পার্বনে এ খেলার বিরাট বিরাট টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হত। রতন মোল্লা ভাড়ায় হাডুডু খেলতেন বেচে থাকার তাগিদে। ’৭১এ যেদিন পাকিরা বন্দুক কামান উচিয়ে ঐ এলাকায় হানা দিল রতন মোল্লা হাডুডুর কৌশলে ঝাপিয়ে পরল স্থানীয় ব্যাংকগুলোর উপর। আরও দু’একজনের সহযোগীতায় ভলট ভেংগে লুটে নেন বেশ ক’টা ব্যাংক। বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যান বিশ্ব ব্রমান্ডের কোন এক অজানা কক্ষে। যুদ্ব শেষে এলাকায় ফিরে আসেন মুক্তিযোদ্বার বেশে, কিন্তূ ততদিনে রতন হতে বনে গেছেন রোকনুদ্দিন মোল্লা। অন্য দশটা মানুসের মত বেহিসাবী না হয়ে মোল্লা সাহেব চতুরতার সাথে আগলে রাখেন উনার টাকা ভর্তি বস্তা এবং সময়মত বিনিয়োগ করে বনে যান বিশিষ্ট শিল্পপতি। একই কথা বলা যাবেনা এলাকার অন্য এক দামী মানুষের বেলায়। এ এস এম শাহজামান, যুদ্বপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান বেতারের ছোটখাট গায়ক। একই কায়দায় ঐ বেচারাও লুটে নেয় নরসিংদী শহরের বেশ ক’টা ব্যাংক। টাকার বস্তা নিয়ে পালিয়ে যায় ভারতে, ওখানে যোগ দেয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ডাক নামে নিজকে পরিচিত করে চলে আসেন খ্যাতির শীর্ষে, ততদিনে শাহজামান নামটা চাপা পরে যায় আপেল মাহমুদ নামের তলায়। আর টাকার বস্তাটা তিনি ধরে রাখতে পারেন্নি কুঅভ্যাসের কারণে।
১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন হয়ে গেল মহাসমারোহে। জানিনা রোকনুদ্দিন মোল্লা এবং আপেল মাহমুদ সাহেবরা বেচে আছেন কিনা, বেচে থাকলে নিশ্চয় অংশীদার হয়েছিলেন জাতির এই গর্বিত দিনের। স্মৃতি রোমান্থন করতে গিয়ে ওনাদের কি মাঝে মধ্যে মনে পরে ৭১’এর সেই দিনগুলির কথা? আমার কেন জানি সংকোচ লাগে এ দিনের এই বিশাল আয়োজনে শামিল হতে, কারণ আশপাশে এমন সব মুখ দেখতে হয় যাদের উত্থানের কালো কাহিনী ৩৮ বছর পরও হজম করতে কষ্ট লাগে।
ও হ্যাঁ, ঢাকা হতে কেউ একজন এসেছিল সে দিন, এবং সরজমিনে তদন্তপূর্বক রোকনুদ্দিন মোল্লাকে মনোনয়ন নয়, বরং পুরস্কৃত করেছিলেন বিএনপি সেন্ট্রাল কমিটির শিল্প বিষয়ক সম্পাদক বানিয়ে। যে নির্বাচনের কথা বলছি সেটা ২০০৮ সালে নয়, এর আগে কোন এক নির্বাচনে।