রহমান ভাইয়ের সাথে পরিচয় পর্বটা ছিল নাটিকতায় ভরা। মধ্য জানুয়ারীতে দেশে যাচ্ছি জরুরী প্রয়োজনে। কথা ছিল নিজেই ড্রাইভ করে জেএফকে পর্য্যন্ত যাব, এয়ারপোর্ট পার্কিং লটে গাড়িটা রেখে ফ্লাইট ধরব। খুব সকালে দরজা খুলতেই মাথায় আকাশ ভেংগে পরল। যতদূর চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। বিরামহীন তুষারপাতে ডুবে গেছে নিউ ইয়র্ক শহর। আগের দিন বাতাসে বরফের গন্ধ ছিল ঠিকই, কিন্তূ একরাতে এতটা পরবে কল্পনা করতে পারিনি। রাস্তায় পার্ক করা গাড়িটাও তলিয়ে গেছে বরফ সমুদ্রে। ওটাকে চলাচল উপযোগী করা ছিল সাধ্যের বাইরে।
৬১ ষ্ট্রীট আর রুজাভেলট্ এভিনিউর কোনায় হলুদ ক্যাব থাকার কথা, উপায় না দেখে ওদিকেই রওয়ানা দিলাম সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে। বেশীদূর যেতে হলনা, ৩৯ এভিনিউর মুখে ইশারা করতেই থেমে গেল খালি ক্যাবটা। ড্রাইভার বাংলাদেশী এবং পরবর্তীতে অনেক ঘটনার স্বাক্ষী আমার রহমান ভাই। বাংলাদেশী ক্যাব ড্রাইভার সাধারণত স্বদেশী যাত্রী টানতে আগ্রহ দেখায়না বিভিন্ন কারণে। কিন্তূ এ যাত্রায় রহমান ভাইকে বেশ অন্যরকম মনে হল। নিজ হাতে লাগেজটাকে ট্রাংকে তুলে আমন্ত্রন জানালেন সামনের সীটে বসার। পরিচয় পর্ব শেষে রহমান ভাই জানতে চাইলেন এত অল্প লাগেজে দেশে যাবার হেতু। কিছুদূর এগুতেই রহমান ভাই অদ্ভূদ একটা অনুরোধ করলেন, উনার ছোট একটা লাগেজ নিয়ে যেতে হবে! কেন জানি না করতে মনে চাইলনা। আমি বল্লাম নিতে অসূবিধা নেই, কিন্তূ নিজ চোখে লাগেজের ভেতরটা দেখতে হবে। অনেকটা ৩৬০ ডিগ্রী এংগেলে কর্কশ একটা আওয়াজ তুলে গাড়িটা ঘুরিয়ে ফেল্লেন তিনি। অচেনা কেউ এমন একটা প্রস্তাবে রাজী হতে পারে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন্নি বোধহয়। সানিসাইডে লম্বা একটা দালানের সামনে গাড়িটা পার্ক করে চিতার গতিতে বেরিয়ে গেলেন। মধ্য মাপের সুটকেসটা নিয়ে ফিরে আসতে বেশী সময় লাগলনা উনার। কাষ্টমস্’এ গাপলা হতে পারে তেমন কিছুই ছিলনা, তাই নিতে কোন অসূবিধা হলনা। সুটকেসটার প্রাপক রহমান ভাইয়ের স্ত্রী, যাকে তিনি গত ১০ বছর দেখেন্নি। হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও রহমান ভাই ক্যাব ভাড়া নিতে রাজী হলেন্না সে যাত্রায়।
ক্যাব ড্রাইভিং ছাড়াও রহমান ভাইয়ের আরও একটা পরিচয় আছে, তিনি বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদী দল বিএনপির একনিষ্ঠ এবং নিবিড় সমর্থক। দলটির শাষনামলে সিরাজগঞ্জ শহরের জনৈক প্রতিমন্ত্রীর ডান হাত হয়ে কাজ করতে গিয়ে হত্যা, ধর্ষন, ব্ল্যাকমেইলিং, লুটতরাজ এবং চাঁদাবাজী সহ হাজারো অপকর্মে জড়িয়ে নিজের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা করেন। এক সময় মন্ত্রীর চারিত্রিক ইন্টিগ্রেটিতে হুমকি হওয়ার কারণে উনাকে বিদেশে পাঠিয়ে মুক্তি পান উটকো ঝামেলা হতে। মন্ত্রী সাহেবের স্থানীয় এজেন্ট হিসাবে কাজ করছেন রহমান ভাই। সানিসাইডে মন্ত্রীর নাকি একটা বাড়িও আছে, যার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব রহমান ভাইয়ের। দেশীয় রাজনীতি করতে গিয়ে ক্লান্তি দেখা দিলে মন্ত্রী সাহবে ছায়া এবং নাট্য দুনিয়ার অনেক উঠতি নায়িকাদের নিয়ে ফুর্তি করতে আসেন নিজ বাড়িতে। রহমান ভাইকেও নাকি মাঝে মধ্যে অংশ দেন, এ নিয়ে উনার রংগিন বর্ণনা অনেক সময় আসল নীল ছবিকেও হার মানায়।
দেশে রাজনৈতিক ঘটনার কোন কমতি থাকেনা। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এসব ঘটনার রেশ নিউ ইয়র্ক পর্য্যন্ত পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগেনা। সংগত কারণেই রহমান ভাই সদা ব্যস্ত প্রিয় দলের খবর সংগ্রহে। এ ছাড়াও উনার অন্যতম একটা কাজ হচ্ছে দেশ হতে আসা বিভিন্ন মাপের নেতাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করা। ভিসার গ্যাড়াকলে আটকে দেশ যাওয়া হয়না অনেকদিন, কিন্তূ তাই বলে দেশ নিয়ে উদ্দীপনার কোন কমতি নেই রহমান ভাইয়ের অন্তরে। একজন দলীয় ক্যাডারের চোখে দেশীয় রাজনীতির বর্ণনা শোনার ইচ্ছে হলেই রহমান ভাইকে ফোন করি। তিনিও আমাকে ফোন করেন, মাঝে মাঝে মধ্যরাতে। এ নিয়ে অভিযোগ করেল হে হে করে হেসে উড়িয়ে দেন আমার অভিযোগ। এভাবেই রহমান ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটা টিকে আছে অনেকগুলো বছর ধরে। দেখা হয়না, কিন্তূ কথা হয়, এবং কথা হয় দেশীয় রাজনীতির অতীত ও বর্তমান নিয়ে (ভবিষত শব্দটার সাথে রহমান ভাইয়ের পরিচয় নেই)।
অনেকদিন পর আমার ফোন পেয়ে উচ্ছাসিত হয়ে উঠলেন রহমান ভাই। কুশলাদীর সংক্ষিপ্ত পর্ব শেষ হতে ফিরে গেলাম সেই ঘুনেধরা, বস্তাপচা রাজনীতিতে। শেখ হাসিনার ভারত সফরের কথা বলতে গিয়ে রহমান ভাইকে মনে হল ক্যাবের সীটের উপর দাঁড়িয়ে গেছেন। দেশ বিক্রীর এমন পাকাপোক্ত চুক্তি করার পরেও কেন যে দেশের মানুষ গর্জে উঠছেনা এ নিয়ে রহমান ভাইয়ের ক্ষোভের শেষ নেই। আমি অবাক হলামনা, বরং এমন একটা জ্বালাময়ী প্রতিক্রীয়া না দেখালেই বরং অবাক হতাম। অনুরোধ করলাম দেশবিক্রীর দলিল ও মিউটেশনের কপি পাওয়া গেলে আমাকে যেন এক কপি মেইল করে দেন। রাগে গর্জাতে থাকেন রহমান ভাই, ’আরে আউলা জাউলা ভাই, আপনে কোনদিনও বাকশালীদের দোষ স্বীকার করবেন্না‘। বলে রাখা ভাল রহমান ভাইয়ের কাছে আমার পরিচিতি একজন মাথা নষ্ট আউলা ঝাউলা মানুষ হিসাবে। নেত্রীর মত উনিও বিশ্বাষ করেন বাংলাদেশে কেবল মাথানষ্ট পাগলরাই নিরপেক্ষ হতে পারে। আমি এ নিয়ে তর্ক করিনা, বরং উপভোগ করি একজন নিবেদিত ভৃত্যের প্রভূ সেবার চমকপ্রদ উপাখ্যান। কথা শেষ করার আগে জানতে চাইলাম রহমান ভাইয়ের ঘনিষ্ট বন্ধু হাইতিয়ান পিটারের কথা। উনি কটা সেকেন্ড চুপ থাকলেন, পিটার প্রসংগে না গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পরলেন, ’দেখলেন তো আউলা ভাই, শেখ হাসিনার ৩দিন সময় লাগলো হাইতির ঘটনা নিয়ে শোক প্রকাশ করতে!‘। হঠাৎ কেন জানি না সদ্য দেখা মনপুরা ছবির একটা দৃশ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠল। নায়িকা পরী চোখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে গাঙের দিকে। দাদির কণ্ঠে বেজে উঠছে, ‘নদীর উপর আকাশ উড়ে, মেঘের ওপার পাখীর বাসা...।‘। পরীও গলা মেলাচ্ছে দাদীর সাথে, গানে গানে প্রামিকা চলে যাচ্ছে প্রেমিক সোনাইয়ের কাছে, স্বপ্নের সোনালী নৌকায় চড়ে প্রেমিক প্রেমিকা ঘুরছে ৩৬০ ডিগ্রী ঘূর্নিতে।
রহমান ভাইদের কাছে হাইতি ফাইতি আসলে কিছু না, উনাদের কাছে সব কিছুর কেন্দ্র ঐ নদীটার মত রাজনীতি, পরী-সোনাইয়ের প্রেম আর তার বিরহের মত রাজনৈতিক চাওয়া পাওয়ার হিসাব। কষ্ট লাগে এ সব নিয়ে ভাবতে গেলে, দুঃখ হয় মাতৃভূমির জন্যে। কিন্তূ বিদেশে বাস করতে গেলে এরাই যে আমাদের আপনজন, সূখ দুখের সাথী। চাইলেও রহমান ভাইদের এড়ানো যায়না, কারন আমার যেমন একজন দরদী ক্যাব ড্রাইভার দরকার, রহমান ভাইদেরও দরকার লাগেজ নিয়ে যাওয়ার কেউ। এসব নিয়েই আমাদের প্রবাসী জীবন।
অভিযোগ তখনও থামেনি, এক নাগাড়ে বক বক করে চলছেন রহমান ভাই। কথা বলতে ইচ্ছে করলনা আমার। নিঃশব্দে রেখে দিলাম ফোনটা।
NB: চরিত্রের নাম ও ঘটনার স্থান বিকৃত করা হয়েছে রহমান ভাইয়ের সন্মানে।