পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা ততক্ষনে ডুবু ডুবু করছে প্রায়। অথচ পুরো ভ্রমনের প্লানটাই ছিল অন্যরকম। সকাল ৯টার ভেতর বেরিয়ে পরব আলবুকেরকে হতে, ১৫০ মাইল (১৯০ কিঃমিঃ) পথ ৩ ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে ১২টার ভেতর পৌঁছে যাব গন্তব্যস্থলে। টায়োস শহরটার এমনিতে কোন বিশেষত্ব নেই, আমেরিকার ওয়াইলড্ ওয়াইলড পশ্চিমের আরও একটা ছোট শহর মাত্র। কিন্তূ এর প্রায় ২০মাইল উত্তরে অবস্থিত স্কি ভ্যালিটাই পর্যটকদের টেনে আনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে। ইউরোপ ছাড়ার পর স্কীর সাথে তেমন একটা যোগযোগ ছিলনা, তাই দু’টা দিনের জন্যে রাজনৈতিক ওয়াচডগী বাদ দিয়ে খোলা প্রকৃতিতে ঘুরে আসার প্রস্তাব করতেই গৃহিনী এক কথায় রাজী হয়ে গেল। নো কম্পুউটার & নো ইন্টারনেট, এই ছিল ভ্রমনের মূল মোটিভ। ঘুম ভাংগতেই বেজে গেল ৯টা। প্রাতরাশ ও আনুসাংগিক প্রস্তূতি পর্ব শেষ করে রওয়ানা দিতে ১২টা বেজে গেল। আই-২৫ হাইওয়ে ধরে নিউ মেক্সিকোর রাজধানী সান্তা ফে পর্য্যন্ত ৫৫ মাইল পথ পাড়ি দিতে খুব একটা সময় লাগলনা। একসিট ২৮২এ ধরে হাইওয়ে হতে বের হয়ে সাউথ সেন্ট ফ্রান্সিসকো ষ্ট্রীট ধরলেই সোজা চলে যাওয়া যায় টায়োস। সান্তা ফে শহরটার বুক চিড়ে চলে গেছে এই রাস্তাটা, যা শহরের বাইরে গিয়ে পরিনত হবে ইউএস-২৮৫ হাইওয়েতে। সান্তা ফে শহরে ঢুকতেই ভিমড়ি খাওয়ার মত অবস্থ হল, পুরো শহরটা ডুবে গেছে আগের রাতের তুষারপাতে। কচ্ছপ গতিতে ড্রাইভ করতে হল। ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝে নিলাম টায়োস পৌঁছে আজ আর স্কী ভ্যালি যাওয়া হচ্ছেনা।
শহর হতে বেরুলেই চোখে পরবে ক্যাসিনোগুলো। আদিবাসি রেড ইন্ডিয়ানদের রিজারভেজনগুলোর প্রায় প্রত্যেকটাতেই আছে একটা করে ক্যাসিনো। ব্যুফেলো থান্ডার বার্ড, স্পোর্টস ক্লাব বার ক্যাসিনো, ওকহ্যি ক্যাসিনো, এ রকম বেশ কটা ক্যাসিনোই হচ্ছে বিভিন্ন পুয়েবলোতে বাসরত রেড ইন্ডিয়ানদের আয় রোজগারের একমাত্র পথ। সব ক’টা তে দশ মিনিট করে ঢু মারা স্বাদ কিছুতেই আটকানো গেলনা বহুমূখী কারণে।
মোটেলটায় ঢুকতেই নেমপ্লেটটা চোখে পরল, শীতল প্যাটেল। কাউন্টারে বসা মধ্য বয়সী রেড ইন্ডিয়ানটাকে লম্বা একটা সালাম দিয়ে জানাতে চাইলাম মোটেল মালিক প্যাটেল সাহেবের দেখা মিলবে কিনা। উত্তরে জানা গেল শীতল প্যাটেল মালিক হলেও উনার বাস ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিস্কোতে। দেখা না হলেও কাজের কাজ হয়ে গেল, কাউন্টারে বসা ভিক্টর মনে করলো মিঃ প্যাটেল আমার পরিচিত কেউ। ১০ ডলার ডিসকাউন্ট দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করল এর চাইতে বেশী দেয়ার অধিকার নেই বলে। মুচকি হেসে লম্বা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঠাই নিলাম মোটেলটায়। রাতের খাবার সাড়তে রাস্তায় বের হতে হল আবারও। ঝাকিয়ে রাত নেমে গেছে ততক্ষনে। ঝাল তরকারীর সাথে ভাত নিয়ে স্থানীয় একটা মেক্সিকান রেষ্টুরেন্টে অনেকক্ষন বসে উপভোগ করলাম সন্ধ্যা রাতটা। টুকটাক কেনাকাটি সেড়ে মোটেলে ফিরতে ১০টা বেজে গেল প্রায়। ততক্ষনে প্রচন্ড শীতে কাপতে শুরু করে দিয়েছে টায়োস শহর।
ঘুম ভাংগল সকাল সাড়ে সাতটায়। মোটেলের ফ্রী প্রাতরাশ সেড়ে দ্রুত রওয়ানা দিতে হবে স্কী ভ্যালির দিকে। কি মনে করে জানালার পর্দাটা সড়াতেই স্তব্দ হয়ে গেলাম। যতদূর চোখ যায় বরফ আর বরফ। প্রচন্ড তুষারঝড় হচ্ছে বাইরে। পাসেও ডেল পুয়েবলো নরটে রাস্তার উপর মানুষ দূরে থাক একটা গাড়িও চোখে পরলনা। হাইওয়েটা চাপা পরে গেছে বরফের নীচে, রাস্তার ঝুলন্ত ট্রাফিক লাইটগুলো বিপদজনকভাবে হেলছে এদিক ওদিক। এক কথায়, থেমে গেছে জনজীবন, সাথে বিপর্য্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। গৃহিনীকে সংবাদটা দিতেই মুখ কালো হয়ে গেল তার। নাস্তা সেড়ে মোটেল হতে বের হতেই চোখে পরল আমাদের গাড়িটা, ও বাবাজিও তুষার নিদ্রায় মগ্ন।
কায়দা কানুন করে গাড়িটাকে মুক্ত করা গেল বরফের আচ্ছাদন হতে। গৃহিনীকে অভয়বানী শুনিয়ে রওয়ানা দিলাম স্কী ভ্যালির দিকে। হাইওয়েতে উঠতেই বুঝতে পারলাম নিজের ভূলটা, রাস্তা চলাচলের উপযোগী নয়। ১০ গজও যাওয়া হয়নি, বরফের উপর স্কিডিং করে ছিটকে পরলাম হাইওয়ে হতে। কোন রকমে জান নিয়ে ফিরে এলাম মোটেলে। টিভি খুলতেই পাওয়া গেল আরও খারাপ খবর, তুষারঝড় সারাদিন ধরে চলবে। মনে মনে হি্সাব কষলাম, এভাবে মোটেলে পরে থাকলে আগামী ক’দিনের জন্যে আটকে থাকতে হবে জনবিচ্ছিন্ন শহরে।
রিস্ক নিতেই হল গৃহিনীর চাকরীর স্বার্থে। মোটেল হতে অসময়ে চেক-আউট করে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে রওয়ানা দিলাম উলটো পথে। ১০০ কিঃমিঃ স্পীডের রাস্তায় ১৫ কিঃমিঃ গতিতে চালিয়েও কন্ট্রোল করা যাচ্ছিলনা গাড়িটাকে, এদিক ওদিক করতে থাকল বেহেড মাতালের মত। এভাবে ঘন্টা দুয়েক চালানোর পর চোখে পরল পরিবর্তনটা, হালকা হয়ে আসছে তুষারপাত। স্পানিওলা নামের শহরটায় আসতেই সূর্যের আলোতে ভেসে গেল চারদিক। এই প্রথম বারের মত রাস্তা পরিস্কারের গাড়িগুলোকেও দেখা গেল টনকে টন লবন ঢালতে। কিছুদূর এগুতেই ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল তুষারপাত। হার্টবিট কমলেও রক্তচাপটা অনুভূত হচ্ছিল ঠিকই।
সান্তা ফে পার হয়ে আই২৫ ধরতেই দৃশ্যপট হতে বিদায় নিল বরফের অস্তিত্ব। মনেই হলনা খুব কাছে কোথাও তুষারপাত হচ্ছে। চারদিকে বরফের অস্তিত্ব না থাকলেও দেখা দিল নতুন এক ঝামেলা, ঝড়ো বাতাস। প্রচন্ড বাতাস গাড়িটাকে ছিটকে নিতে চাইছে হাইওয়ে হতে, সাথে একধরনের শো শো আওয়াজ মনে করিয়ে দিচ্ছিল রুক্ষ্ম পশ্চিমের উপর সেবা সিরিজের অনুদিত বইগুলোর কথা।
আলবুকেরকে শহরের ঝলমলে রৌদ্দুর আমাদের স্বাগত জানাল একরাশ প্রশান্তি নিয়ে। কোন অঘটনা ছাড়াই পৌঁছে গেলাম বাসায়।