লাইজু আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ৯০ দশকের প্রথম দিকে অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার জন্যে ভর্তি হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভোলার লালমোহনে মা-বাবার আদরে বেড়ে উঠা টগবগে তরুন, রাজনীতির সাথে কোনদিনই সম্পৃক্ত ছিলনা। চাক্রী উপলক্ষে আমিও তখন রাজশাহীতে। লাইজুর সাথে দেখা করতে বিশ্ববিদ্যালয় হলে যাওয়া হত মাঝে মধ্যে। প্রথম দর্শনে না হলেও দ্বিতীয়বার হতেই লক্ষ্য করি লাইজুর রাজনৈতিক মেরুকরন। শেষপর্যন্ত নিজেই স্বীকার করল ছাত্র মৈত্রীর সদস্য সে। অবসর পেলেই লাইজুর ক্যম্পাসে ঘুরে বেড়াতাম প্রথমত চমৎকার একটা প্যানোরমার লোভে, দ্বিতীয়ত বিদেশে ফেলে আসা নিজের ছাত্রজীবনকে মনে করার এ ছিল চমৎকার জায়গা। এভাবেই কেটে গেল একটা বছর। চৈত্রের ভ্যপসা গরম রাজশাহীতে কতটা ভয়াবহ কেবল ভুক্তভোগীদেরই জানার কথা। এমনি এক দুপুরে হাজির হলাম লাইজুর হলে। মাবুদ-ই-ইলাহী! লাইজুর রুম বলতে কোন কিছু অবশিষ্ট দেখলামনা। দরজা জানালা গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে, রুমের বিছানাপত্রের উপর বয়ে গেছে কালবৈশাখী। চারদিকে ভাল করে তাকাতেই চাপা একধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত পালালাম ক্যাম্পাস হতে। সূত্র মারফত খবর পেলাম হলে খুনাখুনী চলছে ক্যাম্পাসে এবং লাইজু এক কাপড়ে পালিয়ে গেছে ঢাকার দিকে।
তারপর আর যাওয়া হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। একদিন লাইজু নিজেই এল আমার আস্তানায়। জানাল প্রতিপক্ষের যন্ত্রণায় হলে থাকতে পারছেনা সে। সেশনও পিছিয়ে পরছে একে একে। চেপে ধরলাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ জানতে। তার ভাষায়, রাজনীতি না করলে হলে সীট পাওয়া দায়, যদিও সীট পাওয়া যায় রাজনীতিতে এক্টিভ না থাকলে সে সীট হারানোর সম্ভাবনাও থাকে প্রচুর। শিক্ষকদের রাজনৈতিক মেরুকরনের সাথে তাল না মেলালে পরীক্ষায় ভাল রেজালট্ দূরে থাক, যেনতেন ভাবে পাশকরাও নাকি মুস্কিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে যা চলছে তাতে রাজনৈতিক লেবাস দেয়া হবে আত্ম প্রবঞ্চনার শামিল। ভর্তি বানিজ্য, হলের সীট বরাদ্দ বানিজ্য, অফিস সাপ্লাই বানিজ্য, টেন্ডার বানিজ্য, শিক্ষকদের পরীক্ষা বানিজ্য ও অসূস্থ প্রমোশন লড়াই, এ সব বানিজ্যকে পূঁজি করে ক্যাম্পাসগুলোতে হাত বদল হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আমার দৃষ্টিতে এই হাতবদলই ছাত্রদের চুম্বকের মত টানছে রাজনীতিতে। আমাদের রাজনীতি হচ্ছে অপরাধ শেলটারের চাঁরনভূমি, আর রাজনীতিকে শেল্টার দিচ্ছে দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা। এ যেন দুইয়ে দুইয়ে চার হিসাব মেলানোর মত, একজন অপরাধ করবে অন্যজন আশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে। একদিকে এই চক্রে দলবদ্ব হয়ে দেশের সব্বোর্চ আদালতের বিচারক হতে শুরু করে ব্যুরোক্রেসির গোটা মেশিন, অন্যদিকে শাষনযন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু করে স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান মেম্বার পর্যন্ত হায়েনার মত ছুটছে হাতবদলের বানিজ্যে। বানিজ্য বঞ্চিত হক্ষমতাহারা দলও বসে নেই, তারাও পেশীতে তেল দিচ্ছে নিজদের অংশ আদায়ের উদ্দেশ্যে। যার কারণে রাষ্ট্রযন্ত্রের অলিগলিতে ঘটছে বিরামহীন রক্তপাত। এখানে আদর্শের নামে শিবির, লীগ, দল অথবা মৈত্রীকে আলাদা করার কোন অবকাশ নেই, এরা সবাই একই পাপে পাপী।
এ কথা কারও অজানা নয় সমসাময়িক রাজনীতিতে চুরি চামারির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি।