আগের টার্মেও চেষ্টা হয়েছিল। রীতিমত জোড়ালো চেষ্টা। নীরবে, নিভৃতে ও রাষ্ট্রের স্পনসরে দেশে বিদেশে ধর্ণা দিয়েছিল সরকারের থিংকট্যাংক প্রতিনিধি দল। শোনা যায় কাজটার সফল সমাপ্তির প্রত্যাশায় উচ্চ পর্যায়ে লবিস্ট পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। জাতির কপালে তখন দুর্নীতির হ্যাটট্রিক শিরোপা। চারদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাটের মহোৎসব। পকেটে অনন্ত ক্ষুধা আর হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে শকুনের মত ঝাপিয়ে রাষ্ট্রকে ভাগার বানিয়ে আহার করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে দেশের আমলা বাহিনী। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় ব্যক্তির সন্তুষ্টিই পৌঁছে দেয় অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে এবং পাশাপাশি নিশ্চিত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হরিলুটের অবাধ স্বাধীনতা। দেশীয় রাজনীতির স্বরলিপি লিখতে গেলে এই অধ্যায়টা নিয়ে লেখা যাবে বিশাল এক মহাভারত, যা ইচ্ছা করলে ঠাঁই দেয়া যাবে কার্ল মার্ক্সের ডাচ ক্যাপিটাল ও মাও সে তুং’এর লাল বইয়ের কাতারে। কার্ল মার্ক্স, ভ্লাদিমির উলিয়ানভ আর মাও এর মত শ্রমজীবি ও সর্বহারাদের ভাগ্য পরিবর্তনের পথপ্রদর্শকদের একই কাতারে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ঠাঁই দেয়া অন্যায় হবেনা অভিন্ন কারণে, এরাও ভাগ্য পরিবর্তনের নিপুণ কারিগর। একজন আমানুল্লাহ আমানের বিস্ময়কর উত্থান পর্ব হতে পারে এর নয়নাভিরাম উদাহরণ। যাই হোক, এসব পুরানো কাহিনী। এ নিয়ে অনেক ত্যানা পেঁচানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অনেকের কাছেই আজ তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবেনা। তত্ত্ব বিশ্লেষণের দলীয় ফ্যাক্টরিতে এসবের রেডিমেড উত্তরও হয়ত তৈরী আছে। সময়ের চাহিদা মেটাতে এসবের বাজারজাত এখন আকর্ষনীয় ও লাভজনক ব্যবসা।
কথিত জনতার মঞ্চের নায়ক মহিউদ্দিন আলমগীর সচিব থাকাবস্থায়ই তৈরী করে নিয়েছিলেন আর্ন্তজাতিক কানেকশন। হতে পারে তা সরকারী পদের কারণে। হীরক রাজ্যের রাজা-রানীর তৈলমর্দন, নর্তন, কুর্দন আর ভাঁড়ামি দিয়ে মন জয় করারও একটা লিমিট থাকে, যা আবিস্কার ও এর ব্যবহারের ধান্ধায় ব্যাপক সময় ব্যায় করতে হয় রাজ্যের মন্ত্রী, উজির, নাজির, কোতওয়াল আর ডাজ্ঞাদের। তৈল মর্দনের বৈচিত্র্যতা একটা আর্ট, যা হীরক রাজ্যে ব্যাপক সমাদৃত ও কাঙ্খিত। এই আর্টের মূল্যায়ন করা হয় এর গভীরতা ও রাজা-রানী সন্তুষ্টির কিলোগ্রামের উপর । মহিউদ্দিন খান আলমগীর জানতেন এই বাস্তবতা এবং এই আবিষ্কারে অনেকটাই এগিয়ে যান নিজের যোগাযোগ ও যোগ্যতার দিয়ে। হীরক রাজ্যের রাজাকে খুশি করা মানে ক্ষমতার মাঠে মোহম্মদী বেগের দায়িত্ব পাওয়া। এমনি একটা লাইসেন্স পাওয়ার অভিনব পন্থা আবিস্কার করেন জনাব খান আলমগীর। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রী জোগাড়ের মাধ্যমে রাজার মনোরঞ্জন ইতিপূর্বে কারও তৈলমর্দন ফ্যাক্টরিতে জন্ম না নেয়ায় এর একক কৃতিত্ব চলে যায় এই চতুর আমলার ক্রেডেনশিয়ালে। প্রতিমাসে একটা করে পিএইচডি, এমনটাই নাকি ছিল আমলার টার্গেট। রাষ্ট্রের কোষাগার অনেকটা আলী বাবা ৪০ চোরের সিসিম ফাঁক কায়দায় খুলে দেওয়া হয়েছিল এই ’মহৎ’ কাজের অর্থায়নে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার ফোকর গলে একটা খবর বেশ আলোড়ন তুলেছিল ১৯৭৩-৭৪ সালে। নেতা শেখ মুজিবকে খুশি করার নতুন ও অভিনব পন্থা আবিস্কার করতে গিয়ে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এক ছাত্রীকে ডিগ্রী উপহার দেয় অনেকটা জন্মদিনের উপহারের মত। খবরটা বাতাসে জন্ম নেয়া, তাই সত্যতা যাচাইয়ের কোন উপায় নেই। তবে হীরক মন্ত্রীসভার বর্তমান উজির জনাবা মতিয়া চৌধুরীকে রিমান্ডে আনলে হয়ত এর আসল রহস্য বের করা সম্ভব হবে। পরবর্তীতে একই কায়দায় এই ছাত্রীর ভান্ডারে যোগ হয় আরও অনেক ডিগ্রী। মহিউদ্দিন আলমগীর কর্তৃক যোগাড় করা পিএইচডি তার মধ্যে অন্যতম। একটা দুইটা করে একে একে সাত-আটটা পিএইচডি ডিগ্রী এক সময় মনোরঞ্জনের কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলে। রাজার সন্তুষ্টি লাভের প্রতিযোগীতায় বাধ্য হয়েই উজির নাজিরদের খুজতে হয় ভিন্ন পথ। এই ভিন্ন পথের বাঁকেই দেখা হয় নোবেল পুরস্কার নামক সুসম উপাদানের। জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেত্রীত্বে একদল তৈলমর্দনকারী সন্ধানে নামেন নোবেল শান্তি পুরস্কার নামক সান্ডার তেলের। উপলক্ষ হিসাবে দাঁড় করানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। কথিত আছে এ কাজে কামিয়াবের লক্ষ্যে প্রয়োগ করা হয় দুর্নীতিতে হ্যাটট্রিক শিরোপা লাভের তাবৎ টেকনিক। নোবেল শান্তি পুরস্কার সিলেকশন কমিটির বেশ কজন সদস্যকে গেলানোর চেষ্টা হয় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নগদ নারায়ণ টনিক। খবর নোবেল কমিটির পালের গোদাদের কানে পৌছাতে সময় লাগেনি। ভেস্তে যায় খান আলমগীরের নোবেল নবুয়ত নেটওয়ার্ক। অসলো ও স্টকহোম হতে উচ্চারিত হয় কড়া হুঁশিয়ারী।
৮০ সালের চাটুকারিতা, তোষামোদী আর চোষামোদী বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কোন উপাখ্যান হিসাবে সংযোজিত হয়নি। স্বাধীনতার উষা লগ্নে পাইওনিয়র হিসাবে এ কাজে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন শেখ পরিবারের অন্যতম রাজনীতিবিদ জনাব শেখ ফজলুল হক মনি। কথিত মুজিববাদ নিয়ে বিশ্বব্যাপী হৈচৈ ফেলে দেয়ার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন তিনি। ‘শেখ মুজিবের চিন্তাধারা বিশ্বকে দিচ্ছে নাড়া’ এমন সব উদ্দীপক শ্লোগান সহ অনেকটা চেয়ারম্যান মাও কায়দায় ব্যবহার বান্ধব ছোট ছোট চটি বই বাজারজাত করার চেষ্টা করেছিলেন। পাশাপাশি আলোচনা ও গবেষনার মাধ্যমে নতুন এই বাদকে জাতির খাদ্য তালিকায় বাধ্যতামূলক আইটেম করার চেষ্টা করেছিলেন রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে।
আর্ন্তজাতিক ’সুদখোর’ ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তিকে বলতে গেলে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহন করে থাকবেন হীরক রাজ্যের উজির নাজিরের দল। ’টু বি, অর নট টু বি’ কায়দায় পিতা এবং পারিবারিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগাদা হতেই হয়ত এ চ্যালেঞ্জের জন্ম। ইউনুস মাস্টার নিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বের উচ্ছাস বেশ কিছুটা আতংকের সৃষ্টি করেছিল হীরক রাজ্যে। তাই মাস্টারের মগজ ধোলাই ছিল সময়ের ব্যাপার। রাজ্যের গোপাল ভাড় ও নিবেদিত কোতোয়াল জনাব হানিফের মুখ হতে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল দাবিটা, ইউনুস মাস্টারের নোবেল কেড়ে অন্য কাউকে দিতে হবে। এই অন্যটা অবশ্য কে হবেন তার রূপরেখা উন্মোচিত না করলেও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ৮০ দশকের ভুল হতে ইতিমধ্যে শিক্ষা নিয়েছে হীরক রাষ্ট্র। পকেটে নগদ ধরিয়ে নোবেলে আদায় যে সম্ভব নয় মহিউদ্দিন খান আলমগীরের চেষ্টা হতেই তা প্রমানিত হয়েছিল। রাজ্যের নতুন কোতোয়ালের দল তাই এ পথে না গিয়ে আবিস্কার করল নতুন এক পথ, হীরক রাজ্যের শান্তির মডেল। এই মডেলের সার সংক্ষেপ দেশীয় বাজারে উন্মুক্ত না করে বরং তা সরাসরি এক্সপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাজ্যের অবলা প্রজাদের জানারও সুযোগ হয়নি তাদের রাজার জন্যে বিশ্ব বাজারে মার্কেটিং চলছে। শাটল ডিপ্লোম্যাসির অংশ হিসাবে কথিত শান্তির মডেল ইতিমধ্যে তুলে দেয়া হয়েছে বিশ্বের অনেক রাজা বাদশাদের দরবারে। অবশ্য এবার আর খান আলমগীর নন, এ কাজে নিয়োগ করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত তরুন শক্তি। জাহাঙ্গীর কবির নানক আর মির্জা আযম (প্রাক্তন গোলাম আযম) নামক দুই কোতোয়ালের সৌভাগ্য হয়েছিল হীরক রাজ্যে শান্তির মডেল বাস্তবায়নের চাক্ষুস স্বাক্ষী হতে। বিডিআর নামক সরকারী প্রতিষ্ঠানে চলছে অশান্তি। এই প্রতিষ্ঠানের ৩০৩ রাইফেলধারী সিপাইরা তাদের বসদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হুমকি দিচ্ছে দাবি আদায়ের। বিদ্রোহীদের নেতা ডিডি তৌহিদকে তলব করা হয় হীরক রাজ্যের মগজ ধোলাই কেন্দ্রে। রক্তের সমুদ্র এড়ানোর লক্ষ্যেই নাকি এই নেতাকে তাৎক্ষণিকভাবে বিডিআর প্রধান বানানোর ঘোষনা দেয়া হয় রাজ্য দপ্তর হতে। দেড় শতাধিক অফিসার ও তাদের পরিবারের অনেককে কচুকাটা করে ভাসিয়ে দেয়া হয় মলমূত্রের পাইপ লাইনে। এবার রক্তের মহাসমুদ্র এড়ানোর লক্ষ্যে বিদ্রোহীদের খুন পর্ব সমাধা পূর্বক পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এমনটাই নাকি হীরক রাজ্যের শান্তির মডেল। মির্জা আযম ও নানক গং খুব কাছ হতে অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছিলেন মডেলের বাস্তবায়ন। কোতয়ালদ্বয় মডেলের এই অভাবিত সাফল্যে হতবাক হয়ে হীরক রাজার পদতলে তাৎক্ষণিকভাবে তুলে দেয় ‘শান্তিকন্যা’ উপাধি। হয়ত ক্ষুদ্র উপাধির উপলদ্ধি হতেই জন্ম নিয়েছিল বৃহত্তর বিশ্ব প্রকল্পের।
’সফল’ এই মডেলকে বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র পরিসরে সীমিত রাখা এক অর্থে অন্যায়, পাপ। তাই নানক-আযম গং শেখ মনির মুজিববাদের কায়দায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেবল পূর্ব ইউরোপের চরিত্রহীন দেশগুলোতে নয়, হীরক রাজ্যের শান্তির মডেল ইতিমধ্যে তুলে দেয়া হয়েছে জার্মানীর মত উন্নত দেশের হাতে। দুদিন আগে এ মডেল হস্তগত হয়েছে এক কালের পরাশক্তি রুশ সরকারের হাতে। স্থানীয় মিডিয়ার মতে জার্মানি ও রাশিয়া সহ আরও অনেক দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে স্ব স্ব দেশে এই মডেল বাস্তবায়নের। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মডেল নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্ব শান্তিতে তা কিভাবে প্রয়োগ করা যার তার কৌশল নির্ধারণ করবে এবারের অধিবেশন। অসলোর নোবেল কমিটি চাইলেও এ যাত্রায় বাইন মাছের মত পিছলাতে পারবে বলে মনে হয়না। হীরক রাজ্যের অধিপতিকে যেদিন নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হবে রাজ্যের টেকনাফ হতে তেতুলিয়া পর্যন্ত হাতি নাচবে, ঘোড়া নাচবে, বান্দর গান গাইবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মডেলের বিশ্লেষণ করতে হীরক রাজাকে আমন্ত্রন জানানো হবে। রাজা শত শত পাইক বরকন্দাজ নিয়ে সফরে যাবেন এবং স্বদেশে গণশৌচাগার পর্যন্ত নিজ পিতার নামে নামকরণের স্বার্থকতা বিশ্লেষণ করবেন।
জাতি হিসাবে আমাদের দৈন্যতা, ব্যর্থতা, চটুলতা আর মানসিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে বিশ্ব সমাজ খুব যে একটা উদ্বিগ্ন এমনটা ভাবার কারণ নেই। পৃথিবীর প্রতিটা জাতিরই নিজস্ব কিছু সমস্যা থাকে, যার চৌহদ্দিতেই বেড়ে উঠে সে জাতি। কিন্তু এই বিকলাঙ্গতা যদি ঘর হতে বের করে আর্ন্তজাতিকায়নের চেষ্টা করা হয় সময় আসবে যখন এ নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করবে বিশ্ব সম্প্রদায়। হয়ত উপহাস করবে, বিদ্রুপ করবে। দেশ শাসনে শেখ হাসিনার শান্তির মডেল, এ ধরণের একটা সস্তা ধাপ্পাবাজি কেবল নাইজেরিয়ান স্ক্যামের সাথেই তুলনা করা চলে। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে এ ধরণের অনৈতিক কাজের উদাহরণ দ্বিতীয় একটা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না।
একজন ব্লগারের সাম্প্রতিক লেখা হতে জেনেছি হংকংয়ে একটা যাদুঘর আছে যেখানে প্রদর্শিত হয় দেশটার দুর্নীতির অতীত ইতিহাস। কোন এক সহস্রাব্দে বাংলাদেশও যদি সক্ষম হয় তার অপশাসন, কুশাসন, দুর্নীতি আর ব্যক্তিপুজার কলংকিত অধ্যায় হতে বেরিয়ে আসতে সেদিন নতুন প্রজন্মের শিক্ষার জন্যে হলেও প্রয়োজন হবে নতুন একটা জাদুঘরের, যেখানে কালো অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে হাসিনা, খালেদা, এরশাদ, নিজামী আর আমিনী নামের রাষ্ট্রীয় ভন্ডদের ভণ্ডামির কলংকিত ইতিহাস।